পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/৯২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৮৮
ঘরে-বাইরে

তার স্বাভাবিক অধিকার ছাড়িয়ে এত দূর পর্যন্ত তাকে বাড়িয়ে তুলেছি যে, আজ তাকে সমস্ত মনুষ্যত্বের দোহাই দিয়েও বশে আনতে পারছি নে। ঘরের প্রদীপকে ঘরের আগুন করে তুলেছি। এখন তাকে আর প্রশ্রয় দেওয়া যায় না, তাকে অবজ্ঞা করবার দিন এসেছে। প্রবৃত্তির হাতের পূজা পেয়ে পেয়ে সে দেবীর রূপ ধরে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু তার সামনে পুরুষের পৌরুষ বলি দিয়ে তাকে রক্তপান করাতে হবে, এমন পূজা আমরা মানব না। সাজে-সজ্জায়, লজ্জা-শরমে, গানে-গল্পে, হাসি-কান্নায়, যে ইন্দ্রজাল সে তৈরি করেছে তাকে ছিন্ন করতে হবে।

 কালিদাসের ঋতুসংহার কাব্যের উপর বরাবর আমার একটা ঘৃণা আছে। পৃথিবীর সমস্ত ফুলের সাজি, সমস্ত ফলের ডালি কেবলমাত্র প্রেয়সীর পায়ের কাছে পড়ে পঞ্চশরের পূজার উপচার জোগাচ্ছে, জগতের আনন্দলীলাকে এমন করে ক্ষুন্ন করতে মানুষ পারে কী করে! এ কোন্ মদের নেশায় কবির চোখ ঢুলে পড়েছে। যে-মদ এতদিন পান করছি তার রঙ এত লাল নয়, কিন্তু তার নেশা তাে এমনিই তীব্র। এই নেশার ঝোঁকেই আজ সকাল থেকে গুন্‌গুন্ করে মরছি—

ভরা বাদর, মাহ ভাদর,
শূন্য মন্দির মাের!

 শূন্য মন্দির! বলতে লজ্জা করে না! এত বড়াে মন্দির কিসে তােমার শূন্য হল! একটা মিথ্যাকে মিথ্যা বলে জেনেছি, তাই বলে জীবনের সমস্ত সত্য আজ উজাড় হয়ে গেল!


 শােবার ঘরের শেলফ্ থেকে একটা বই আনতে আজ সকালে গিয়েছিলুম। কত দিন দিনের বেলায় আমার শােবার ঘরে আমি ঢুকি নি। আজ দিনের আলােতে ঘরের দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল। সেই আন্‌লাটিতে বিমলের কোঁচানাে শাড়ি পাকানাে রয়েছে, এক কোণে তার ছাড়া শেমিজ আর জামা ধোবার জন্যে অপেক্ষা করছে। আয়নার টেবিলের উপর তার চুলের কাঁটা, মাথার তেল, চিরুনি, এসেন্সের শিশি, সেইসঙ্গে সিদুরের কৌঁটোটিও। টেবিলের নীচে তার ছােট্ট সেই একজোড়া জরি-দেওয়া চটিজুতাে— একদিন যখন বিমল কোনােমতেই জুতাে পরতে চাইত না সেই সময়ে আমি ওর জন্যে আমার এক লক্ষৌয়ের সহপাঠী মুসলমান বন্ধুর যােগে এই জুতাে আনিয়ে দিয়েছিলুম। কেবলমাত্র শােবার ঘর থেকে আর ঐ বারান্দা পর্যন্ত এই জুতাে পরে যেতে সে লজ্জায় মরে গিয়েছিল। তার