পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/৯৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৯০
ঘরে-বাইরে

একটা ঝুড়িতে গােটাকতক ঝুনাে নারকেল নিয়ে আমার সামনে রেখে গড় হয়ে প্রণাম করলে।

 আমি জিজ্ঞাসা করলুম, একি পঞ্চু, এ কেন?

 পঞ্চু আমার প্রতিবেশী জমিদার হরিশ কুণ্ডুর প্রজা, মাস্টারমশায়ের যােগে তার সঙ্গে আমার পরিচয়। একে আমি তার জমিদার নই, তার উপরে সে গরিবের একশেষ; ওর কাছ থেকে কোনাে উপহার গ্রহণ করবার অধিকার আমার নেই। মনে ভাবছিলুম, বেচারা বােধ হয় আজ নিরুপায় হয়ে বক্‌শিশের ছলে অন্নসংগ্রহের এই পন্থা করেছে।

 পকেটের টাকার থলি থেকে দুটো টাকা বের করে যখন ওকে দিতে যাচ্ছি তখন ও জোড়-হাত করে বললে, না হুজুর, নিতে পারব না।

 সেকি পঞ্চু?

 না, তবে খুলে বলি। বড়াে টানাটানির সময় একবার হুজুরের সরকারি বাগান থেকে আমি নারকেল চুরি করেছিলুম। কোন্ দিন মরব, তাই শােধ করে দিতে এসেছি।

 আমিয়েল্‌স্‌ জর্নাল পড়ে আজ আমার কোনাে ফল হত না। কিন্তু পঞ্চুর এই এক কথায় আমার মন খােলসা হয়ে গেল। একজন স্ত্রীলােকের সঙ্গে মিলন-বিচ্ছেদের সুখ-দুঃখ ছাড়িয়ে এ পৃথিবী অনেক দূর বিস্তৃত। বিপুল মানুষের জীবন; তারই মাঝখানে দাঁড়িয়ে তবেই যেন নিজের হাসিকান্নার পরিমাপ করি!

 পঞ্চু আমার মাস্টারমশায়ের একজন ভক্ত। কেমন করে এর সংসার চলে তা আমি জানি। রােজ ভােরে উঠে একটা চাঙারিতে করে পান দোক্তা, রঙিন সুতাে, ছােটো আয়না, চিরুনি প্রভৃতি চাষার মেয়েদের লােভনীয় জিনিস নিয়ে হাঁটুজল ভেঙে বিল পেরিয়ে সে নমঃশূদ্রদের পাড়ায় যায়। সেখানে এই জিনিসগুলাের বদলে মেয়েদের কাছ থেকে ধান পায়। তাতে পয়সার চেয়ে কিছু বেশিই পেয়ে থাকে। যেদিন সকাল সকাল ফিরতে পারে সেদিন তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে বাতাসাওয়ালার দোকানে বাতাসা কাটতে যায়। সেখান থেকে বাড়ি ফিরে এসে শাঁখা তৈরি করতে বসে; তাতে প্রায় রাত দুপুর হয়ে যায়। এমন বিষম পরিশ্রম করেও বছরের মধ্যে কেবল কয়েক মাস ছেলেপুলে নিয়ে দু-বেলা দুমুঠো খাওয়া চলে। তার আহারের নিয়ম এই যে, খেতে বসেই সে এক-ঘটি জল খেয়ে পেট ভরায়, আর তার খাদ্যের মস্ত একটা অংশ হচ্ছে সস্তা দামের বীজে-কলা। বছরে অন্তত চার মাস তার এক-বেলার বেশি খাওয়া জোটে না।