অত্যন্ত আঘাত করিত। এই বেদনার উত্তেজনাতেই, আমরা তখন এতটা দিক্বিদিক্ জ্ঞানশূন্য হইয়া আমাদের ধর্ম্মের ও সমাজের সংস্কারসাধনে নিযুক্ত হইয়াছিলাম। আমাদের এই সংস্কার-চেষ্টা যদি সর্ব্বতোভাবে খৃষ্টীয়ানী পন্থা অনুসরণ করিয়া চলিতে পারিত তাহা হইলে সেই চেষ্টার ফলে আমাদিগের মধ্যে কোনো প্রকারের সত্য স্বাদেশিকতা ফুটিয়া উঠিতে পারিত না। কিন্তু যে ব্যক্তিত্বাভিমান বা Individualism এবং যুক্তিবাদ বা Rationalism, আমাদিগকে নিজেদের সমাজের ও ধর্ম্মের অনুশাসনকে অগ্রাহ্য করিতে প্রণোদিত করে, তাহারই প্রভাবে আমাদিগের পক্ষে খৃষ্ট-ধর্ম্মে বিশ্বাস স্থাপন এবং য়ুরোপীয় সমাজবিধানের বশ্যতাগ্রহণও একান্তই অসাধ্য করিয়া তুলে। স্বদেশের বেদপুরাণাদিকে মনুষ্য-প্রতিভা-রচিত এবং সাধারণ মানব-বুদ্ধি-সহজ ভ্রম-কল্পনা-প্রসূত বলিয়া, প্রামাণ্য-মর্য্যাদা নষ্ট করিয়া, খৃষ্টীয়ানের বাইবেলকে ঈশ্বরপ্রণীত ও অভ্রান্ত বলিয়া গ্রহণ করিবার আর কোনো পথ রহিল না। শ্রীকৃষ্ণের অবতারত্ব উড়াইয়া দিয়া, যীশু খৃষ্টের অবতারত্বে বিশ্বাস করা অসাধ্য হইল। অথচ এইরূপ অবস্থাতেও যখন খৃষ্টীয়ান ধর্ম্ম-প্রচারকেরা হিন্দু-ধর্ম্মের উপরে নিজেদের ধর্ম্মের আত্যন্তিক শ্রেষ্ঠত্বের দাবী সপ্রমাণ করিতে যাইয়া প্রতিবাদী ধর্ম্মের মত ও বিশ্বাসের সিদ্ধান্ত ও সাধনার হীনতা প্রমাণ করিতে অগ্রসর হইলেন, তখন তাঁহাদের এই অযথা নিন্দাবাদের ফলেই,—যে স্বদেশের ধর্ম্মকে এককালে আমরা হীন বলিয়া বর্জ্জন করিয়াছিলাম, তাহারই সম্বন্ধে ক্রমে আমাদিগের প্রাণে একটা প্রবল শ্রেষ্ঠত্বাভিমান জাগিয়া উঠিল। মানুষ এ জগতে নিজের প্রাণের মধ্যে যে ভাব লইয়া অপর মানুষের নিকটে যায়, তাহার প্রাণেও অলক্ষিতে সেই ভাবেরই সঞ্চার করে। প্রেম এই জন্য প্রেমকে ফোটায়। ঘৃণা ঘৃণাকেই বাড়াইয়া দেয়। একের অহঙ্কার-অভিমান, অপরের অহঙ্কার-
পাতা:চরিত-কথা - বিপিনচন্দ্র পাল (১৯১৬).pdf/৪৭
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৪২
চরিত-কথা