হইতেই আমাদিগের স্বদেশপ্রীতির এই অপূর্ব্ব উদারতার উৎপত্তি হইয়াছে। এই আধুনিক স্বাদেশিকতা এ পর্য্যন্ত বাংলা, মহারাষ্ট্র ও পাঞ্জাব, এই তিন প্রদেশেই বিশেষভাবে ফুটিয়া উঠিয়াছে। কিন্তু বাংলার স্বাদেশিকতার আদর্শ যতটা উদার ও উন্নত, মহারাষ্ট্রের কিম্বা পাঞ্জাবের স্বাদেশিকতার আদর্শ ততটা উদার ও উন্নত নহে। ইংরেজ এদেশে না আসিলে ভারতরাষ্ট্রে মারাঠা ও শিখ, ইঁহারাই সম্ভবতঃ মোগলের উত্তরাধিকারী হইয়া দেশের শাসন-শক্তিকে অধিকার করিয়া বসিতেন। ব্রিটিশপ্রভুশক্তির প্রতিষ্ঠায় তাঁহাদের সে আশা নির্ম্মূল হইলেও তাহার স্মৃতি শিখ বা মারাঠার চিত্ত হইতে একেবারে লুপ্ত হয় নাই। আর এই কারণে পাঞ্জাবের কিম্বা মহারাষ্ট্রের স্বাদেশিকতার মধ্যে একটা প্রাদেশিক পক্ষপাতিত্ব লুকাইয়া আছে। বাংলায় সেরূপ কোনো ঐতিহাসিক স্মৃতি নাই বলিয়াই, বাঙালীর স্বাদেশিকতার কোনো প্রাদেশিক আশ্রয়ও নাই। অন্যদিকে বাঙালীর প্রকৃতিও শিখ বা মারাঠার প্রকৃতির মত নহে। শিখ খাল্সা ভারতমাতার বাহুতেই বল সঞ্চার করিয়াছে, কিন্তু বিশেষ ভাবে তাঁহার বাণীশক্তি অধিকার করিতে পারে নাই। অন্যদিকে মারাঠা ও বাঙালী ইহাদের বুদ্ধি-বল ভারতের অপরাপর জাতির বুদ্ধিবল হইতে শ্রেষ্ঠ হইলেও বাঙালীর বুদ্ধিতে ও মারাঠার বুদ্ধিতে প্রভেদও বিস্তর। মারাঠার বুদ্ধি কার্য্যকরী, ইংরাজিতে ইহাকে practical বলে। বাঙালীর বুদ্ধি ভাবময়ী, ইংরাজিতে ইহাকে idealistic বলা যায়। কার্য্যকরী বুদ্ধি ফলসন্ধিৎসু; কর্ম্মাকর্ম্মের আসন্ন ফল লক্ষ্য করিয়া চলে। ভাবময়ী বুদ্ধি সত্যসন্ধিৎসু; কর্ম্মাকর্ম্মের প্রত্যক্ষ ফলাফলকে অগ্রাহ্য করিয়া ভাবরাজ্যে ও তত্ত্বাঙ্গে তাঁহার কি পরিণাম ঘটিবে, তাহাই কেবল দেখে। কার্য্যকরী বুদ্ধি আদর্শকে উপেক্ষা করিয়া বাস্তবকে ধরিতে চাহে; ভাবমন্ত্রী বুদ্ধি বাস্তবকে উপেক্ষা করিয়া আদর্শেতেই
পাতা:চরিত-কথা - বিপিনচন্দ্র পাল (১৯১৬).pdf/৫৫
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫০
চরিত-কথা