গীতগোবিন্দ
মহাকবিরা রসের ভেতর দিয়ে যে সুধা পরিবেশন করেন, তার মূল্য শত উপদেশ গ্রন্থ বা তত্ত্বকথার গ্রন্থের চেয়ে বেশী। এই রসের মন্ত্র হলো সব চেয়ে বড় পাবক মন্ত্র।
জয়দেব সেই রসের পাবক মন্ত্রে সেই সময়কার বাংলার তৃষ্ণা-বিভ্রান্ত চিত্তকে পরিশুদ্ধ করে গেলেন। বর্ত্তমান বৈজ্ঞানিক যুগে এক শ্রেণীর চিকিৎসক যেমন খাদ্যের ভেতর দিয়ে রোগ-চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন, খাদ্যের ভেতরেই ওতপ্রোতভাবে থেকে যায় অসুস্থ দেহের প্রয়োজনীয় ঔষধ, তেমনি জগতের মহাকবিরা রসের ভেতর দিয়েই করেন ব্যাধিগ্রস্ত মানবতার চিকিৎসা। তাই প্রতিদিনের জগতের হিসাবী লোকেরা কবিদের রস-সাধনাকে যেখানে অবাস্তব বলে বিজ্ঞতার পরিচয় দেয়, জগতের বিজ্ঞ-লোকেরা সেখানে সুনিশ্চিত ভাবে জানেন মহাকবিদের এই রস-সাধনার মধ্যেই আছে সামাজিক ব্যাধির একান্ত প্রয়োজনীয় পরমৌষধি।
তাই জয়দেবের গীতগোবিন্দ যেমন একদিক থেকে হলো কাব্যের রসঘনমূর্ত্তি; যে-প্রেম হলো জীবনের ধাত্রী, যাকে আলঙ্কারিকেরা বলেছেন আদিরস, সংস্কৃত ভাষায় সেই আদিরসের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ লিরিক কবিতা, তেমনি আর একদিক থেকে এই কাব্য তার আদি-রসেরই অপূর্ব্ব পাবক রসায়নে বাংলার চিত্তভূমিকে চিরকালের মতন সরস আর্দ্র করে দিয়ে যায়। পুঁথির শুষ্ক অনুশাসন আর বুদ্ধির বন্ধ্যা যুক্তিকে পরিত্যাগ করে পরবর্ত্তী যুগে চৈতন্যদেব প্রেম ও ভক্তির যে মহাবীর্য্য ও প্রাণ-ঐশ্বর্য্যকে জাগিয়ে তুললেন, সাহিত্যে তার ভিত্তি তৈরী করেন তিনজন কবি—বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস ও জয়দেব।