মান
প্রেম যখন গাঢ় হয়ে ওঠে, তখন প্রিয়তমের নব নব মাধুর্য্যের স্বাদে অন্তর ভরপূর হয়ে থাকে। সেই পরিপূর্ণতার মধ্যে অন্তরে এক বিচিত্র অদাক্ষিণ্য দেখা দেয়। প্রিয়তমের সামান্য ত্রুটিতে মন বিরূপ হয়ে ওঠে। কারণে ও অকারণে তখন মানের প্রকাশ হয়। এই মান হলো, প্রণয়কে নিবিড়ভাবে আস্বাদন করবার আর একটা উপায়। কারণ মান করবার মধ্যে সব চেয়ে সংগোপন আনন্দের বিষয় হলো, অন্তরের বিশ্বাস, যে এই মান ভাঙবার জন্যে প্রিয়তম আছে। চিরমধুর যে তাকে নব নব রূপে ভোগ করবার জন্যেই মানের লীলা। মান নায়িকার হতে পারে, নায়কেরও হতে পারে। মানের দুটী রূপ। একটী হলো সহেতু মান, আর দ্বিতীয়টী হলো নির্হেতু মান। সহেতু মানের প্রধান লক্ষণ হলো, ঈর্ষা। নির্হেতু মানের উদাহরণ হলো—রাধা-কৃঞ্চ বিহার করছেন; হঠাৎ শ্রীমতীর নজরে পড়লো শ্রীকৃষ্ণের বক্ষস্থিত কৌস্তুভ-মণিতে পড়েছে তাঁর ছায়া। সেই ছায়া-নারীকে অন্য নারী মনে করে শ্রীমতীর অন্তরে জাগে মান। সহেতু মানের আবার দুটী রকম আছে। একটী হলো সাধারণ মান, আর একটী হলো দুর্জয় মান। জয়দেব কবির গীতগোবিন্দ হলো মানেরই কাব্য। তাঁর কাব্যের রস নির্ভর করছে, শ্রীমতীর মান ও শ্রীকৃষ্ণের মানভঞ্জনের ওপর। নায়িকার মানের আটটী প্রধান কারণ, (১) সখীর মুখে প্রিয়তমের ঔদাসীন্যের বার্ত্তা শ্রবণ, (২) শুক পাখীর মুখে অন্য নায়িকার নাম শ্রবণ, (৩) দূর থেকে বাঁশীর স্বর শ্রবণ, (৪) নায়কের দেহে নখচিহ্ন ইত্যাদি রতি-চিহ্ন দর্শন, (৫) প্রতিপক্ষ নায়িকার অঙ্গে রতি-ভোগের চিহ্ন দর্শন, (৬) নায়ক কর্ত্তৃক স্বপ্নে অন্য নারীর নাম উচ্চারণ, (4) স্বপ্নে প্রিয়তমকে অন্য নারীর সংসর্গে দর্শন ও (৮) প্রত্যক্ষভাবে প্রিয়তমকে অন্য নারীর সংসর্গে দর্শন।
মানের ভেতরকার আসল কথা মহাপ্রভু তাঁর রচিত একটী শ্লোকে বলে গিয়েছেন,
আশ্লিষ্য বা পাদরতাং পিনষ্টু মামদর্শনান্-
মর্মহতাং করোতু বা।
যথা তথা বা বিদধাতু লম্পটো
মৎপ্রাণনাথস্তু স এব নাপরঃ॥
এর মর্ম্মার্থ হলো, শ্রীমতী বলছেন, যত রকমে সম্ভব সেই লম্পট আমাকে কষ্ট দিক্ না কেন, তবু সেই আমার প্রাণ-নাথ, দ্বিতীয় আর কেউ নেই আমার!