চিত্রে জয়দেব
আভাস পাওয়া যায়, তা থেকে একথা স্পষ্ট বোঝা যায় যে, পরবর্ত্তী যুগে শ্রীচৈতন্য বাংলাদেশে প্রেম ও ভক্তির যে নব-উন্মাদনা নিয়ে আসেন, তার স্পষ্ট লক্ষণ ফুটে ওঠে জয়দেবের জীবনে ও সাধনায়। জয়দেবের অলৌকিক প্রেম আর ভক্তি হলো মহাপ্রভুর অগ্রদূতস্বরূপ। তাঁর জীবন ও সাধনার ভেতর দিয়ে তিনি বাংলাদেশকে সেই মহারূপান্তরের প্রস্তুতি দিয়ে গেলেন। গীতগোবিন্দে তিনি যে প্রেমের গান গাইলেন, সেই প্রেমকে জীবনে দিব্য সত্যরূপে ফুটিয়ে তোলবার জন্যেই এলেন মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য।
তের
এইভাবে লোক-মুখে-মুখে জয়দেবের প্রেম ও ভক্তির কাহিনী, তাঁর অপরূপ কাব্য-প্রতিভার কথা গৌড়ের রাজসভায় গিয়ে পৌঁছল।
তখন বল্লালসেন গত হয়েছেন। গৌড়ের সিংহাসনে রাজা লক্ষ্মণ সেন। পিতার কাছ থেকে লক্ষ্মণ সেন পেয়েছিলেন, মহত্তর জীবনের প্রতি একটা সুতীব্র অনুরাগ। বল্লালসেন মৃতপ্রায় বাংলার সামাজিক জীবনকে কৌলীন্যের গুণগত বিভাগে এক নতুন প্রেরণা দিয়ে যান। প্রতিদিনের জীবনের গড্ডলিকাপ্রবাহ থেকে জনতার চিত্তকে তিনি মহত্তর অস্তিত্বের, মহত্তর জীবনের দিকে আকৃষ্ট করেন। পিতার সেই আদর্শবাদ পূরামাত্রায় লক্ষ্মণ সেন পেয়েছিলেন। তাই তিনি বাংলাদেশে সঙ্গীত, সাহিত্য, শিল্পকলার পরিপূর্ণ বিকাশের দ্বারা এক উন্নততর জীবনাদর্শ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন এবং সে-যুগের রীতি অনুযায়ী তিনি নিজেকে কাব্য-সঙ্গীত ও শিল্পের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ পৃষ্ঠপোষকরূপে জাহির করেন। বিক্রমাদিত্যের নবরত্নের মতন তাঁর মনে এক সুতীব্র বাসনা জেগে ওঠে, তাঁর রাজসভায় তিনি দেশের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভাদের স্থান দেবেন। তাই দেখি, তাঁর সভায় সে-যুগের বাংলার সর্ব্বশ্রেষ্ঠ কবিদের সম্মেলন। এইভাবে দেখি তাঁর রাজসভায় কবি উমাপতি ধর, গোবর্দ্ধন আচার্য্য, কবি শরণ ও কবি ধোয়ী এবং করি জয়দেব মিশ্র। এই বিশ্বমণ্ডলীর মধ্যে কবি জয়দেবের নামের সঙ্গেই আমরা সবিশেষ পরিচিত। বিক্রমাদিত্যের সভায় কালিদাসের মতন, লক্ষ্মণ সেনের রাজসভায় কবি জয়দেবের নাম ও কীর্ত্তিই তাঁর রাজসভাকে অমর করে রেখেছে।
[ছাব্বিশ]