পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১১৮
চোখের বালি

অনন্ত জগতের প্রতি একটা অবজ্ঞা নিক্ষেপ করিয়া মনে মনে কহিল, ‘যে আমাকে যত ম মনে করে করুক, কিন্তু আমি ভালােবাসি।’ বলিয়া বিনােদিনীর মানসীমূর্তিকে দিয়া মহেন্দ্র সমস্ত আকাশ, সমস্ত সংসার, সমস্ত কর্তব্য আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল। বিহারী হঠাৎ আসিয়া আজ যেন মহেন্দ্রের জীবনের ছিপি-আঁটা মসীপাত্র উলটাইয়া ভাঙিয়া ফেলিল— বিনােদিনীর কালাে চোখ এবং কালাে চুলের কালি দেখিতে দেখিতে বিস্তৃত হইয়া পূর্বেকার সমস্ত সাদা এবং সমস্ত লেখা লেপিয়া একাকার করিয়া দিল।


২৯

পরদিন ঘুম ভাঙিয়া বিছানা হইতে উঠিবা মাত্রই একটি মধুর আবেগে মহেন্দ্রের হৃদয় পূর্ণ হইয়া গেল। প্রভাতের সূর্যালােক যেন তাহার সমস্ত ভাবনায় বাসনায় সোনা মাখাইয়া দিল। কী সুন্দর পৃথিবী, কী মধুময় আকাশ, বাতাস যেন পুষ্পরেণুর মত সমস্ত মনকে উড়াইয়া লইয়া যাইতেছে।

 সকালবেলায় বৈষ্ণব ভিক্ষুক খােল করতাল বাজাইয়া গান জুড়িয়া দিয়াছিল। দরােয়ান তাড়াইয়া দিতে উদ্যত হইলে, মহেন্দ্র দরোয়ানকে ভর্ৎসনা করিয়া তখনই তাহাদিগকে একটা টাকা দিয়া ফেলিল। বেহারা কেনােসিনের ল্যাম্প লইয়া যাইবার সময় অসাবধানে ফেলিয়া দিয়া চুরমার করিল; মহেন্দ্রের মুখের দিকে তাকাইয়া ভয়ে তাহার প্রাণ শুকাইয়া গেল, মহেন্দ্র তিরস্কারমাত্র না করিয়া প্রসন্নমুখে কহিল, “ওরে, ওখানটা ভালাে করিয়া ঝাঁট দিয়া ফেলিস, যেন কাহারে পায়ে কাঁচ না ফোটে।”

 আজ কোনাে ক্ষতিকেই ক্ষতি বলিয়া মনে হইল না।

 প্রেম এতদিন নেপথ্যের আড়ালে লুকাইয়া বসিয়া ছিল, আজ সে সম্মুখে আসিয়া পর্দা উঠাইয়া দিয়াছে। জগৎসংসারের উপর হইতে আবরণ উঠিয়া গেছে। প্রতিদিনের পৃথিবীর সমস্ত তুচ্ছতা আজ অন্তর্হিত হইল। গাছপালা, পশুপক্ষী, পথের জনতা, নগরের কোলাহল, সকলই আজ অপরূপ। এই বিশ্বব্যাপী নূতনতা এতকাল ছিল কোথায়।

 মহেন্দ্রের মনে হইতে লাগিল, আজ যেন বিনােদিনীর সঙ্গে অন্য দিনের মতাে সামান্য ভাবে মিলন হইবে না। আজ যেন কবিতায় কথা বলিলে এবং সংগীতে ভাব প্রকাশ করিলে, তবে ঠিক উপযুক্ত হয়। আজিকার দিনকেও ঐশ্বর্যে সৌন্দর্যে পূর্ণ করিয়া মহেন্দ্র সৃষ্টিছাড়া সমাজছাঁড়া একটা আরব্য উপন্যাসের অদ্ভুত দিনের