পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৩২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১২৮
চোখের বালি

উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিরার জন্য তাহার বক্ষকবাটে আঘাত করিল। সেই আঘাত সংবরণ করিয়া লইয়া সে স্মিতহাস্যে ঘরে প্রবেশ করিয়া সদ্যস্নাতা রাজলক্ষ্মীকে প্রণাম করিয়া তাঁহার পায়ের ধূলা লইল। বিহারী যখন সর্বদা যাতায়াত করিত তখন এরূপ অভিবাদন তাহাদের প্রথা ছিল না। আজ যেন সে বহুদূরপ্রবাস হইতে পুনর্বার ঘরে ফিরিয়া আসিল। বিহারী প্রণাম করিয়া উঠিবার সময় রাজলক্ষ্মী সস্নেহে তাহার মাথায় হস্তস্পর্শ করিলেন।

 রাজলক্ষ্মী আজ নিগূঢ় সহানুভূতি-বশত বিহারীর প্রতি পূর্বের চেয়ে অনেক বেশি আদর ও স্নেহ প্রকাশ করিলেন। কহিলেন, “ও বেহারি, তুই এতদিন জাসিস নাই কেন। আমি রোজ মনে করিতাম, আজ নিশ্চয় বেহারি আসিবে, কিন্তু তোর আর দেখা নাই।”

 বিহারী হাসিয়া কহিল, “রোজ আসিলে তো তোমার বিহারীকে রোজ মনে করিতে না, মা। মহিনদা কোথায়।”

 রাজলক্ষ্মী বিমর্ষ হইয়া কহিলেন, “মহিনের আজ কোথায় নিমন্ত্রণ আছে, সে আজ কিছুতেই থাকিতে পারিল না।”

 শুনিবামাত্র বিহারীর মনটা বিকল হইয়া গেল। আশৈশব প্রণয়ের শেষ এই পরিণাম! একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া মন হইতে সমস্ত বিষাদবাষ্প উপস্থিতমত তাড়াইয়া দিবার চেষ্টা করিয়া বিহারী জিজ্ঞাসা করিল, “আজ কী রান্না হইয়াছে শুনি।”

 বলিয়া তাহার নিজের প্রিয় ব্যঞ্জনগুলির কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল। রাজলক্ষ্মীর রন্ধনের দিন বিহারী কিছু অতিরিক্ত আড়ম্বর করিয়া নিজেকে লুদ্ধ বলিয়া পরিচয় দিত; আহারলোলুপতা দেখাইয়া বিহারী মাতৃহৃদয়শালিনী রাজলক্ষ্মীর স্নেহ কাডিয়া লইত। আজও তাহার স্বরচিত ব্যঞ্জন সম্বন্ধে বিহারীর অতিমাত্রায় কৌতূহল দেখিয়া, রাজলক্ষ্মী হাসিতে হাসিতে তাঁহার লোভাতুর অতিথিকে আশ্বাস দিলেন।

 এমন সময় মহেন্দ্র আসিয়া বিহারীকে শুষ্ক স্বরে দস্তুরমত জিজ্ঞাসা করিল, “কী বিহারী, কেমন আছ।”

 রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “কই মহিন, তুই তোর নিমন্ত্রণে গেলি না?”

 মহেন্দ্র লজ্জা ঢাকিতে চেষ্টা করিয়া কহিল, “না, সেটা কাটাইয়া দেওয়া গেছে।”

 স্নান করিয়া আসিয়া বিনোদিনী যখন দেখা দিল, তখন বিহারী প্রথমটা কিছুই বলতে পারি না। বিনোদনী ও মনের যে দৃশ্য সে দেখিয়াছিল, তাহ তাহার মণে মুদ্রিত ছিল।