পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৬৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চোখের বালি
১৬৫

তোমাকে কিছুমাত্র বাধা দিব না। আমি তোমাকে স্পর্শ করিয়া আজ শপথ করিয়া বলিতেছি, তুমি যখন যেমন ইচ্ছা কর তাহাই হইবে— দয়া যদি কর তবে বাঁচিব, না যদি কর তবে তোমার পথ হইতে দূরে চলিয়া যাইব। আমি সংসারে নানা অবিশ্বাসের কাজ করিয়াছি, কিন্তু আজ আমাকে অবিশ্বাস করিয়ো না। আমরা প্রলয়ের মুখে দাঁড়াইয়াছি, এখন ছলনা করিবার সময় নহে।”

 বিনোদিনী অত্যন্ত সহজভাবে অবিচলিত মুখে কহিল, “আমাকে সঙ্গে লইয়া চলো। তোমার গাড়ি আছে?”

 মহেন্দ্র কহিল, “আছে।”

 বিনোদিনীর দিদিশাশুড়ি ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিয়া কহিল, “মহেন্দ্র, তুমি আমাকে চেন না, কিন্তু তুমি আমার পর নও। তোমার মা রাজলক্ষ্মী আমাদের গ্রামেরই মেয়ে, গ্রামসম্পর্কে আমি তাহার মামী। জিজ্ঞাসা করি, এ তোমার কী রকম ব্যবহার। ঘরে তোমার স্ত্রী আছে, মা আছে, আর তুমি এমন বেহায়া উন্মত্ত হইয়া ফিরিতেছ! ভদ্রসমাজে তুমি মুখ দেখাইবে কী বলিয়া।”

 মহেন্দ্র যে ভাবোন্মাদের রাজ্যে ছিল, সেখানে এই একটা আঘাত লাগিল। তাহার মা আছে, স্ত্রী আছে, ভদ্রসমাজ বলিয়া একটা ব্যাপার আছে। এই সহজ কথাটা নূতন করিয়া যেন মনে উঠিল। এই অজ্ঞাত সুদূর পল্লীর অপরিচিত গৃহদ্বারে মহেন্দ্রকে যে এমন কথা শুনিতে হইবে ইহা তাহার এক সময়ে স্বপ্নেরও অতীত ছিল। দিনের বেলায় গ্রামের মাঝখানে দাঁড়াইয়া সে একটি ভদ্রঘরের বিধবা রমণীকে ঘর হইতে পথে বাহির করিতেছে, মহেন্দ্রের জীবনচরিতে এমনও একটা অদ্ভুত অধ্যায় লিখিত হইল! তবু তাহার মা আছে, স্ত্রী আছে এবং ভদ্রসমাজ আছে।

 মহেন্দ্র যখন নিরুত্তর হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল তখন বৃদ্ধা কহিল, “যাইতে হয় তো এখনই যাও, এখনই যাও! আমার ঘরের দাওয়ায় দাঁড়াইয়া থাকিয়ো না— আর এক মুহূর্তও দেরি করিয়ো না।”

 বলিয়া বৃদ্ধা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া ভিতর হইতে দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিল। অস্নাত অভুক্ত মলিনবস্ত্র বিনোদিনী শূন্যহস্তে গাড়িতে গিয়া উঠিল। মহেন্দ্র যখন গাড়িতে উঠিতে গেল বিনোদনী কহিল, “না, স্টেশন দূরে নয়, তুমি হাঁটিয়া যাও।”

 মহেন্দ্র কহিল, “তাহা হইলে গ্রামের সকল লোক আমাকে দেখিতে পাইবে।”

 বিনোদিনী কহিল, “এখনো তোমার লজ্জা বাকি আছে?”

 বলিয়া গাড়ির দরজা বন্ধ করিয়া বিনোদনী গাড়োয়ানকে বলিল, “স্টেশনে চলো।”