পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৪
চোখের বালি

 মহেন্দ্র কহিল, “দরকার আছে মা, তুমি দাও-না, আমি পরে বলিব”

 মহেন্দ্র একটু সাজ না করিয়া থাকিতে পারিল না। পরের জন্য হইলেও কন্যা দেখিবার প্রসঙ্গমাত্রেই যৌবনধর্ম আপনি চুলটা একটু ফিরাইয়া লয়, চাদরে কিছু গন্ধ ঢালে।

 দুই বন্ধু কন্যা দেখিতে বাহির হইল।

 কন্যার জেঠা শ্যামবাজারের অনুকুলবাবু নিজের উপার্জিত ধনের দ্বারায় তাঁহার বাগান-সমেত তিনতলা বাড়িটাকে পাড়ার মাথার উপর তুলিয়াছেন।

 দরিদ্র ভ্রাতার মৃত্যুর পর পিতৃমাতৃহীনা ভ্রাতুষ্পপুত্রীকে তিনি নিজের বাড়িতে আনিয়া রাখিয়াছেন। মাসি অন্নপূর্ণা বলিয়াছিলেন,‘আমার কাছে থাক্‌; তাহাতে ব্যয়লাঘবের সুবিধা ছিল বটে, কিন্তু গৌরবলাঘবের ভয়ে অনুকুল রাজি হইলেন না। এমন-কি, দেখাসাক্ষাৎ করিবার জন্যও কন্যাকে কখনো মাসির বাড়ি পাঠাইতেন না, নিজেদের মর্যাদা সম্বন্ধে তিনি এতই কড়া ছিলেন!

 কন্যাটির বিবাহ-ভাবনার সময় আসিল, কিন্তু আজকালকার দিনে কন্যার বিবাহ সম্বন্ধে ‘যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধির্ভবতি তাদৃশী’ কথাটা খাটে না। ভাবনার সঙ্গে খরচও চাই। কিন্তু পণের কথা উঠিলেই অনুকুল বলেন,‘আমার তো নিজের মেয়ে আছে, আমি একা আর কত পারিয়া উঠিব।’ এমনি করিয়া দিন বহিয়া যাইতেছিল। এমন সময় সাজিয়া-গুজিয়া গন্ধ মাখিয়া রঙ্গভূমিতে বন্ধুকে লইয়া মহেন্দ্র প্রবেশ করিলেন।

 তখন চৈত্রমাসের দিবসান্তে সূর্য অস্তোন্মুখ। দোতলার দক্ষিণ-বারান্দায় চিত্রিত চিক্বণ চীনের টালি গাঁথা; তাহারই প্রান্তে দুই অভ্যাগতের জন্য রুপার রেকাবি ফলমূলমিষ্টান্নে শোভমান এবং বরফ-জল পূর্ণ রুপার গ্লাস শীতল শিশিরবিন্দুজালে মণ্ডিত। মহেন্দ্র বিহারীকে লইয়া আলজ্জিতভাবে খাইতে বসিয়াছেন। নীচে বাগানে মালী তখন ঝারিতে করিয়া গাছে গাছে জল দিতেছিল; সেই সিক্ত মৃত্তিকার স্নিগ্ধ গন্ধ বহন করিয়া চৈত্রের দক্ষিণবাতাস মহেন্দ্রের শুভ্র কুঞ্চিত সুবাসিত চাদরের প্রান্তকে দুর্দাম করিয়া তুলিতেছিল। আশপাশের দ্বার-জানালার ছিদ্রান্তরাল হইতে একটু-আধটু চাপা হাসি, ফিসফিস্ কথা, দুটা একটা গহনার টুংটাং যেন শুনা যায়।

 আহারের পর অনুকুলবাবু ভিতরের দিকে চাহিয়া কহিলেন,”চুনি, পান নিয়ে আয় তো রে।”

 কিছুক্ষণ পরে সংকোচের ভাবে পশ্চাতে একটা দরজা খুলিয়া গেল এবং একটি