কোণে বসিয়া পড়াশুনা করিতেছিল, কাহারো কোনো এলাকায় ছিল না― মাঝে হইতে মার ব্যামোর কথা পাড়িয়া তাহাকে ঘরছাড়া করিয়া তোমার কী সুখ হইল। আমি এখানে মরিয়া থাকিলে তাহাতে কাহার কী ক্ষতি হইত। দুঃখেও তোমার ঘটে এইটুকু বুদ্ধি আসিল না!
বলিয়া বিছানার উপর শুইয়া পড়িলেন।
বাহিরে মস্মস্ শব্দ শোনা গেল। বেহারা কহিল, “ডাক্তারবাবু আয়া।” ভাক্তার কাশিয়া ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। আশা তাড়াতাড়ি ঘোমটা টানিয়া খাটের অন্তরালে গিয়া দাঁড়াইল। ডাক্তার জিজ্ঞাসা করিল, “আপনার কী হইয়াছে বলুন তো।”
রাজলক্ষ্মী ক্রোধের স্বরে কহিলেন, “হইবে আর কী। মানুষকে কি মরিতে দিবে না। তোমার ওষুধ খাইলেই কি অমর হইয়া থাকিব।”
ডাক্তার সান্ত্বনার স্বরে কহিল, “অমর করিতে না পারি, কষ্ট যাহাতে কমে সে চেষ্টা—”
রাজলক্ষ্মী বলিয়া উঠিলেন, “কষ্টের ভালো চিকিৎসা ছিল যখন বিধবারা পুড়িয়া মরিত— এখন এ তো কেবল বাঁধিয়া মারা। যাও ডাক্তারবাবু, তুমি যাও― আমাকে আর বিরক্ত করিয়ো না, আমি একলা থাকিতে চাই।”
ডাক্তার ভয়ে ভয়ে কহিল, “আপনার নাড়িটা একবার―”
রাজলক্ষ্মী অত্যন্ত বিরক্তির স্বরে কহিলেন, “আমি বলিতেছি তুমি যাও। আমার নাড়ি বেশ আছে— এ নাড়ি শীঘ্র ছাড়িবে এমন ভরসা নাই।”
ডাক্তার অগত্যা ঘরের বাহিরে গিয়া আশাকে ডাকিয়া পাঠাইল। আশাকে নবীন-ডাক্তার রোগের সমস্ত বিবরণ জিজ্ঞাসা করিল। উত্তরে সমস্ত শুনিয়া গম্ভীরভাবে ঘরের মধ্যে পুনরায় প্রবেশ করিল। কহিল, “দেখুন, মহেন্দ্র আমার উপর বিশেষ করিয়া ভার দিয়া গেছে। আমাকে যদি আপনার চিকিৎসা করিতে না দেন, তবে সে মনে কষ্ট পাইবে।”
মহেন্দ্র কষ্ট পাইবে, এ কথাটা রাজলক্ষ্মীর কাছে উপহাসের মতো শুনাইল। তিনি কহিলেন, “মহিনের জন্য বেশি ভাবিয়ো না। কষ্ট সংসারে সকলকেই পাইতে হয়। এ কষ্টে মহেন্দ্রকে অত্যন্ত বেশি কাতর করিবে না। তুমি এখন যাও ডাক্তার। আমাকে একটু ঘুমাইতে দাও।”
নবীন-ডাক্তার বুঝিল, রোগীকে উত্ত্যক্ত করিলে ভালো হইবে না। ধীরে ধীরে বাহিরে আসিয়া যাহা কর্তব্য আশাকে উপদেশ দিয়া গেল।