পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চোখের বালি
২৩১

 তখন রাজলক্ষ্মী মহেন্দ্রকে ভূতল হইতে উঠিয়া তাঁহার খাটে বসিতে ইঙ্গিত করিলেন। মহেন্দ্র খাটে বসিলে রাজলক্ষ্মী মহেন্দ্রের পার্শ্বে স্থান-নির্দেশ করিয়া আশাকে কহিলেন, “বউমা, এইখানেই তুমি বোসো― আজ আমি একবার তোমাদের দুজনকে একত্রে বসাইয়া দেখিব, তাহা হইলে আমার সকল দুঃখ ঘুচিবে। বউমা, আমার কাছে আর লজ্জা করিয়ো না, আর মহিনের ’পরেও মনের মধ্যে কোনো অভিমান না রাখিয়া একবার এইখানে বোসো— আমার চোখ জুড়াও মা।”

 তখন ঘোমটা-মাথায় আশা লজ্জায় ধীরে ধীরে আসিয়া কম্পিতবক্ষে মহেন্দ্রের পাশে গিয়া বসিল। রাজলক্ষ্মী স্বহস্তে আশার ডান হাত তুলিয়া লইয়া মহেন্দ্রের ডান হাতে রাখিয়া চাপিয়া ধরিলেন; কহিলেন, “আমার এই মাকে তোর হাতে দিয়া গেলাম মহিন— আমার এই কথাটি মনে রাখিস, তুই এমন লক্ষ্মী আর কোথাও পাবি নে। মেজবউ, এসো, ইহাদের একবার আশীর্বাদ করো— তোমার পুণ্যে ইহাদের মঙ্গল হউক।”

 অন্নপূর্ণা সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইতেই উভয়ে চোখের জলে তাঁহার পদধুলি গ্রহণ করিল। অন্নপূর্ণা উভয়ের মস্তকচুম্বন করিয়া কহিলেন, “ভগবান তোমাদের কল্যাণ করুন।”

 রাজলক্ষ্মী। বিহারী, এসো বাবা, মহিনকে তুমি একবার ক্ষমা করো।

 বিহারী তখনই মহেন্দ্রের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইতেই মহেন্দ্র উঠিয়া দৃঢ় বাহ দ্বারা বিহারীকে বক্ষে টানিয়া লইয়া কোলাকুলি করিল।

 রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “মহিন, আমি তোকে এই আশীর্বাদ করি— শিশুকাল হইতে বিহারী তোর যেমন বন্ধু ছিল চিরকাল তেমনি বন্ধু থাক্‌— ইহার চেয়ে তোর সৌভাগ্য আর-কিছু হইতে পারে না।”

 এই বলিয়া রাজলক্ষ্মী অত্যন্ত ক্লান্ত হইয়া নিস্তব্ধ হইলেন। বিহারী একটা উত্তেজক ঔষধ তাঁহার মুখের কাছে আনিয়া ধরিতেই রাজলক্ষ্মী হাত সরাইয়া দিয়া কহিলেন, “আর ওষুধ না বাবা! এখন আমি ভগবানকে স্মরণ করি— তিনি আমাকে আমার সমস্ত সংসারদাহের শেষ ওষুধ দিবেন। মহিন, তোরা একটুখানি বিশ্রাম কর্ গে। বউমা, এইবার রান্না চড়াইয়া দাও।”

 সন্ধ্যাবেলায় বিহারী এবং মহেন্দ্র রাজলক্ষ্মীর বিছানার সম্মুখে নীচে পাত পাড়িয়া খাইতে বসিল। আশার উপর রাজলক্ষ্মী পরিবেশনের ভার দিয়াছিলেন, সে পরিবেশন করিতে লাগিল।