পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৩৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চোখের বালি
২৩৩

 বিহারী কহিল, “বিনোদিনী কলিকাতায় আছে।”

 রাজলক্ষ্মী নীরব দৃষ্টিতে বিহারীকে প্রশ্ন করিলেন। বিহারী তাহা বুঝিল। কহিল, “বিনোদিনীর জন্য তুমি আর কিছুমাত্র ভয় করিও না মা।”

 রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “সে আমাকে অনেক দুঃখ দিয়াছে বিহারী, তবু তাহাকে আমি মনে মনে ভালোবাসি।”

 বিহারী কহিল, “সেও তোমাকে মনে মনে ভালোবাসে মা।”

 রাজলক্ষ্মী। আমারও তাই বোধ হয় বিহারী। দোষগুণ সকলেরই আছে, কিন্তু সে আমাকে ভালোবাসিত। তেমন সেবা কেহ ছল করিয়া করিতে পারিত না।

 বিহারী কহিল, “তোমার সেবা করিবার জন্য সে ব্যাকুল হইয়া আছে।”

 রাজলক্ষ্মী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, “মহিনরা তো এখন শুইতে গেছে, রাত্রে তাহাকে একবার আনিলে কি ক্ষতি আছে।”

 বিহারী কহিল, “মা, সে তো এই বাড়িরই বাহির-ঘরে লুকাইয়া বসিয়া আছে। তাহাকে আজ সমস্ত দিন জলবিন্দু পর্যন্ত মুখে দেওয়াইতে পারি নাই। সে পণ করিয়াছে, যতক্ষণ তুমি তাহাকে ডাকিয়া না মাপ করিবে ততক্ষণ সে জলস্পর্শ করিবে না।”

 রাজলক্ষ্মী ব্যস্ত হইয়া কহিলেন, “সমস্ত দিন উপবাস করিয়া আছে! আহা, তাহাকে ডাক্, ডাক্।”

 বিনোদিনী ধীরে ধীরে রাজলক্ষ্মীর ঘরে প্রবেশ করিতেই তিনি বলিয়া উঠিলেন, “ছি ছি বউ, তুমি করিয়াছ কী। আজ সমস্ত দিন উপোস করিয়া আছ! যাও যাও, আগে খাইয়া লও, তাহার পরে কথা হইবে।”

 বিনোদিনী রাজলক্ষ্মীর পায়ের ধুলা লইয়া প্রণাম করিয়া কহিল, “আগে তুমি পাপিষ্ঠাকে মাপ করো পিসিমা, তবে আমি খাইব।”

 রাজলক্ষ্মী। মাপ করিয়াছি বাছা, মাপ করিয়াছি, আমার এখন কাহারো উপর আর রাগ নাই।

 বিনোদিনীর ডান হাত ধরিয়া তিনি কহিলেন, “বউ, তোমা হইতে কাহারো মন্দ না হউক, তুমিও ভালো থাকো।”

  বিনোদিনী। তোমার আশীর্বাদ মিথ্যা হইবে না পিসিমা, আমি তোমার পা ছুঁইয়া বলিতেছি, আমা হইতে এ সংসারের মন্দ হইবে না।

 অন্নপূর্ণাকে বিনোদিনী ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিয়া খাইতে গেল। খাইয়া