পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৪০
চোখের বালি

 বিনোদিনী বিহারীকে কহিল, “এখন আমার প্রতি তোমার যাহা আদেশ, তাহা বলো।”

 বিহারী কহিল, “বোঠান, তুমিই বলো, তুমি কী করিতে চাও।”

 বিনোদিনী কহিল, “শুনিলাম, গরিবদের চিকিৎসার জন্য গঙ্গার ধারে তুমি একখানি বাগান লইয়াছ― আমি সেখানে তোমার কোনো একটা কাজ করিব। কিছু না হয় তো আমি রাঁধিয়া দিতে পারি।

 বিহারী কহিল, “বোঠান, আমি অনেক ভাবিয়াছি। নানান হাঙ্গামে আমাদের জীবনের জালে অনেক জট পড়িয়া গেছে। এখন নিভৃতে বসিয়া বসিয়া তাহারই একটি একটি গ্রন্থি মোচন করিবার দিন আসিয়াছে। পূর্বে সমস্ত পরিষ্কার করিয়া লইতে হইবে। এখন হৃদয় যাহা চায় তাহাকে আর প্রশয় দিতে সাহস হয় না। এপর্যন্ত যাহা-কিছু ঘটিয়াছে, যাহা-কিছু সহ্য় করিয়াছি, তাহার সমস্ত আবর্তন, সমস্ত আন্দোলন শান্ত করিতে না পারিলে জীবনের সমাপ্তির জন্য প্রস্তুত হইতে পারিব না। যদি সমস্ত অতীতকাল অনুকূল হইত তবে সংসারে একমাত্র তোমার দ্বারাই আমার জীবন সম্পূর্ণ হইতে পারিত― এখন তোমা হইতে আমাকে বঞ্চিত হইতেই হইবে। এখন আর সুখের জন্য চেষ্টা বৃথা, এখন কেবল আস্তে আস্তে সমস্ত ভাঙচুর সারিয়া লইতে হইবে।”

 এই সময় অন্নপূর্ণা ঘরে ঢুকিতেই বিনোদিনী কহিল, “মা, আমাকে তোমার পায়ে স্থান দিতে হইবে। পাপিষ্ঠা বলিয়া আমাকে তুমি ঠেলিয়ো না।”

 অন্নপূর্ণা কহিলেন, “মা, চলো, আমার মনেই চলো।”

 অন্নপূর্ণা ও বিনোদিনীর কাশীতে যাইবার দিন কোনো সুযোগে বিহারী বিরলে বিনোদিনীর সহিত দেখা করিল। কহিল, “বোঠান, তোমার একটা-কিছু চিহ্ন আমি কাছে রাখিতে চাই।”

 বিনোদিনী কহিল, “আমার এমন কী আছে যা চিহ্নের মতো কাছে রাখিতে পার?”

 বিহারী লজ্জা ও সংকোচের সহিত কহিল, “ইংরেজের একটা প্রথা আছে, প্রিয়জনের একগুচ্ছ চুল স্মরণের জন্য রাখিয়া দেয়— যদি তুমি—”

 বিনোদিনী। ছি ছি, কী ঘৃণা। আমার চুল লইয়া কী করিবে। সেই অশুচি মৃতবস্তু আমার এমন কিছুই নহে যাহা আমি তোমাকে দিতে পারি। আমি হতভাগিনী তোমায় কাছে থাকিতে পারি না— আমি এমন একটা-কিছু দিতে চাই যাহা আমার হইয়া তোমার কাজ করিবে— বলো, তুমি লইবে?