পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩৬
চোখের বালি

নোটের খাতা হাতপাখার অ্যাক্টিনি করিয়া রান্নাঘরের ভস্মশয্যায় বিশ্রাম করিতে লাগিল।

 এই-সকল অভাবনীয় ব্যবস্থাবিপর্যয়ে মহেন্দ্রের কৌতুকের সীমা রহিল না, কিন্তু আশা ব্যথিত হইতে থাকিল। উচ্ছৃখল যথেচ্ছাচারের স্রোতে সমস্ত ঘরকন্না ভাসাইয়া হাস্যমুখে ভাসিয়া চলা বালিকার কাছে বিভীষিকাজনক বলিয়া বোধ হইতে লাগিল।

 একদিন সন্ধ্যার সময় দুইজনে ঢাকা-বারান্দায় বিছানা করিয়া বসিয়াছে। সম্মুখে খোলা ছাদ। বৃষ্টির পরে কলিকাতার দিগন্তব্যাপী সৌধশিখরশ্রেণী জ্যোৎস্নায় প্লাবিত। বাগান হইতে রাশীকৃত ভিজা বকুল সংগ্রহ করিয়া আশা নতশিরে মালা গাঁথিতেছে। মহেন্দ্র তাহা লইয়া টানাটানি করিয়া, বাধা ঘটাইয়া প্রতিকুল সমালোচনা করিয়া অনর্থক একটা কলহ সৃষ্টি করিবার উদ্যোগ করিতেছিল। আশা এই-সকল অকারণ উৎপীড়ন লইয়া তাহাকে ভর্ৎসনা করিবার উপক্রম করিবা মাত্র মহেন্দ্র কোনো একটি কৃত্রিম উপায়ে আশার মুখ বন্ধ করিয়া শাসনবাক্য অঙ্কুরেই বিনাশ করিতেছিল।

 এমন সময় প্রতিবেশীর বাড়ির পিঞ্জরের মধ্য হইতে পোষা কোকিল কুহু কুহু করিয়া ডাকিয়া উঠিল। তখনই মহেন্দ্র এবং আশা তাহাদের মাথার উপরে দোদুল্যমান খাঁচার দিকে দৃষ্টিপাত করিল। তাহদের কোকিল প্রতিবেশী কোকিলের কুহুধবনি কখনো নীরবে সহ্য করে নাই, আজ সে জবাব দেয় না কেন।

 আশা উৎকণ্ঠিত হইয়া কহিল, “পাখির আজ কী হইল।”

 মহেন্দ্র কহিল, “তোমার কণ্ঠ শুনিয়া লজ্জাবোধ করিতেছে।”

 আশা সানুনয় স্বরে কহিল, “না, ঠাট্টা নয়, দেখো-না উহার কী হইয়াছে।”

 মহেন্দ্র খাঁচা পাড়িয়া নামাইল। খাচার উপরের আবরণ খুলিয়া দেখিল, পাখি মরিয়া গেছে। অন্নপূর্ণা যাওয়ার পর বেহারা ছুটি লইয়া গিয়াছিল, পাখিকে কেহ দেখে নাই।

 দেখিতে দেখিতে আশার মুখ ম্লান হইয়া গেল। তাহার আঙুল চলিল না— ফুল পড়িয়া রহিল। মহেন্দ্রের মনে আঘাত লাগিলেও, অকালে রসভঙ্গের আশঙ্কায় ব্যাপারটা সে হাসিয়া উড়াইবার চেষ্টা করিল। কহিল, “ভালোই হইয়াছে; আমি ডাক্তারি করিতে যাইতাম আর ওটা কুহুস্বরে তোমাকে জালাইয়া মারিত।”

 এই বলিয়া মহেন্দ্র আশাকে বাহুপাশে বেষ্টন করিয়া কাছে টানিয়া লইবার চেষ্টা করিল।