গরম চা এবং ছোটো রেকাবতে দুই-একটি মিষ্টান্ন ধরিয়া দিল। বিনোদিনী বারবার বলিতে লাগিল, “ভাগ্যে বিহারীবাবু সমস্ত উদ্যোগ করিয়া আনিয়াছিলেন, তাই তো রক্ষা! নহিলে চা না পাইলে মহেন্দ্রবাবুব কী দশা হইত।”
চা পাইয়া মহেন্দ্র বাচিয়া গেল, তবু বলিল, “বিহারীর সমস্ত বাড়াবাড়ি। চড়িভাতি করিতে আসিয়াছি, এখানেও সমস্ত দস্তুরমত আয়োজন করিয়া আসিয়াছে! ইহাতে মজা থাকে না।”
বিহারী কহিল, “তবে দাও ভাই, তোমার চায়ের পেয়ালা; তুমি না খাইয়া মজা করো গে— বাধা দিব না।”
বেলা হয়, চাকররা আসিল না। বিহারীর বাক্স হইতে আহারাদির সর্বপ্রকার সরঞ্জাম বাহির হইতে লাগিল। চাল-ডাল-তরি-তরকারি এবং ছোটো ছোটো বোতলে বিচিত্র পেষা মসলা আবিষ্কৃত হইল। বিনোদিনী আশ্চর্য হইয়া বলিতে লাগিল, “বিহারীবাবু, আপনি যে আমাদেরও ছাড়াইয়াছেন! ঘরে তো গৃহিণী নাই, তবে শিখিলেন কোথা হইতে।”
বিহারী কহিল, “প্রাণের দায়ে শিখিয়াছি, নিজের যত্ন নিজেকেই করিতে হয়।”
বিহারী নিতান্ত পরিহাস করিয়া কহিল, কিন্তু বিনোদিনী গম্ভীর হইয়া বিহারীর মুখে করুণ চক্ষের কৃপা বর্ষণ করিল।
বিহারী ও বিনোদিনীতে মিলিয়া রাঁধাবাড়ায় প্রবৃত্ত হইল। আশা ক্ষীণ সংকুচিত ভাবে হস্তক্ষেপ করিতে আসিলে বিহারী তাহাতে বাধা দিল। অপটু মহেন্দ্র সাহায্য করিবার কোনো চেষ্টাও করিল না। সে গুঁড়ির উপরে হেলান দিয়া একটা পায়ের উপরে আর-একটা পা তুলিয়া কম্পিত বটপত্রের উপরে রৌদ্রকিরণের নৃত্য দেখিতে লাগিল।
রন্ধন প্রায় শেষ হইলে পর বিনোদিনী কহিল, “মহিনবাবু, আপনি ঐ বটের পাতা গণিয়া শেষ করিতে পারিবেন না, এবারে স্নান করিতে যান।”
ভূত্যের দল এতক্ষণে জিনিসপত্র লইয়া উপস্থিত হইল। তাহাদের গাড়ি পথের মধ্যে ভাঙিয়া গিয়াছিল। তখন বেলা দুপুর হইয়া গেছে।
আহারান্তে সেই বটগাছের তলায় তাস খেলিবার প্রস্তাব হইল; মহেন্দ্র কোনোমতেই গা দিল না, এবং দেখিতে দেখিতে ছায়াতলে ঘুমাইয়া পড়িল। আশা বাড়ির মধ্যে গিয়া দ্বার রুদ্ধ করিয়া বিশ্রামের উদ্যোগ করিল।
বিনোদিনী মাথার উপর একটুখানি কাপড় তুলিয়া দিয়া কহিল, “আমি তবে ঘরে যাই।”