পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৯৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৯২
চোখের বালি

  মাতার উত্তরোত্তর শ্লেষবাক্যে মহেঞ্জের মন একেবারে কঠিন হইয়া বাকি৪,, সে কোনো উত্তর না দিয়া আশাকে কাশী পাঠাইতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইয়া চলিয়া গেল।

 বিহারী যখন রাজলক্ষ্মীর সঙ্গে দেখা করিতে আসিল রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “ও বিহারী, শুনিয়াছিল? আমাদের বউমা যে কাশী যাইতে ইচ্ছা করিয়াছেন।” বিহারী কহিল, “বল কী মা, মহিনদা আবার কালেজ কামাই করিয়া যাইবে?” রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “না, না, মহিন কেন যাইবেন। তা হইলে আর বিবিয়ানা হইল কই। মহিন এখানে থাকিবেন, বউ তাহার জেঠামহারাজের সঙ্গে কাশী যাইবেন। সবাই সাহেব-বিবি হইয়া উঠিল।”

 বিহারী মনে মনে উদবিগ্ন হইল— বর্তমান কালের সাহেবিয়ানা স্মরণ করিয়া নহে। বিহারী ভাবিতে লাগিল, ‘ব্যাপারখানা কী। মহেন্দ্র যখন কাশী গেল, আশা এখানে রহিল; আবার মহেন্দ্র যখন ফিরিল তখন আশা কাশী যাইতে চাহিতেছে; দুজনের মাঝখানে একটা কী গুরুতর ব্যাপার ঘটিয়াছে। এমন করিয়া কতদিন চলিবে। বন্ধু হইয়াও আমরা ইহার কোনো প্রতিকার করিতে পারিব না— দূরে দাড়াইয়া থাকিব?'

 মাতার ব্যবহারে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হইয়া মহেন্দ্র তাহার শয়নঘরে আসিয়া বসিয়া ছিল। বিনোদিনী ইতিমধ্যে মহেন্দ্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নাই— তাই আশা তাহাকে পাশের ঘর হইতে মহেন্দ্রের কাছে লইয়া আসিবার অন্ত অনুরোধ করিতেছিল।

 এমন সময় বিহারী আসিয়া মহেন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করিল, “আশা-বোঠানের কি কাশী যাওয়া স্থির হইয়াছে।”

 মহেন্দ্র কহিল, “না হইবে কেন। বাধাটা কী আছে।” বিহারী কহিল, “বাধার কথা কে বলিতেছে। কিন্তু হঠাৎ এ খেয়াল তোমাদের মাথায় আসিল যে?”

 মহেন্দ্র কহিল, “মাসিমাকে দেখিবার ইচ্ছা, প্রবাসী আত্মীয়ের জন্য ব্যাকুলতা, মানবচরিত্রে এমন মাঝে মাঝে ঘটিয়া থাকে।”

 বিহারী জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি সঙ্গে যাইতেছ?”

 প্রশ্ন শুনিয়াই মহেন্দ্র ভাবিল, জেঠার সঙ্গে আশাকে পাঠানো সংগত নহে, এই কথা লইয়া আলোচনা করিতে বিহারী আসিয়াছে – পাছে অধিক কথা বলিতে গেলে ক্রোধ উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠে, তাই সংক্ষেপে বলিল, “না।”

 বিহারী মহেন্দ্রকে চিনিত। সে যে রাগিয়াছে, তাহা বিহারীর অগোচর ছিল