পাতা:ছন্দ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৫৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৩২
ছন্দ

সংষ্কৃত বল, পারসি বল, ইংরেজি বল সব শব্দকেই প্রাণের প্রয়োজনে আত্মসাৎ করতে পারে।[১] খাঁটি হিন্দি ভাষারও সেই গুণ। যারা হেডপণ্ডিত মশায়ের কাছে পড়েনি তাদের একটা লেখা তুলে দিই।

চক্ষু আঁধার দিলের ধোঁকায়
কেশের আড়ে পাহাড় লুকায়,
কী রঙ্গ সাঁই দেখছে সদাই
বসে নিগম ঠাঁই।
এখানে না দেখলেম তারে
চিনব তবে কেমন করে,
ভাগ্যেতে আখেরে তারে
চিনতে যদি পাই।[২]

প্রাকৃত-বাংলাকে গুরুচণ্ডালি দোষ স্পর্শ ই করে না। সাধু ছাঁদের ভাষাতেই শব্দের মিশোল সয় না।

 চলতি বাংলাভাষার প্রসঙ্গটা দীর্ঘ হয়ে পড়ল। তার কারণ এ-ভাষাকে যাঁরা প্রতিদিন ঘরে দেন স্থান, তাঁদের অনেকে সাহিত্যে একে অবজ্ঞা করেন। সেটাতে সাহিত্যকে তার প্রাণরসের মূল আধার থেকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে জেনে আমার আপত্তিকে বড়ো করেই জানালুম। ছন্দের তত্ত্ববিচারে ভাষার অন্তর্নিহিত ধ্বনিপ্রকৃতির বিচার অত্যাবশ্যক, সেই কথাটা এই উপলক্ষ্যে বোঝাবার চেষ্টা করেছি।

8

বাংলা ছন্দের তিনটি শাখা। একটি আছে পুঁথিগত কৃত্রিম ভাষাকে অবলম্বন করে, সেই ভাষায় বাংলার স্বাভাবিক ধ্বনিরূপকে স্বীকার করেনি।[৩] আর-একটি সচল বাংলার ভাষাকে নিয়ে, এই ভাষা বাংলার হসন্ত-শব্দের ধ্বনিকে আপন বলে গ্রহণ করেছে।[৪] আর-একটি শাখার উদ্গম হয়েছে সংস্কৃত ছন্দকে বাংলায় ভেঙে নিয়ে।[৫]

  1. দ্রষ্টব্য ৫১ পৃষ্ঠা।
  2. লালন-রচিত: প্রবাসী ১৩২২ আশ্বিন।
  3. সাধুছন্দ বা সংস্কৃত-বাংলার ছন্দ।
  4. ছড়ার ছন্দ বা প্রাকৃত-বাংলার ছন্দ।
  5. রবীন্দ্রনাথ অন্য কোথাও এ-শাখাটিকে স্বতন্ত্র নামে উল্লেখ করেননি। অসম ও বিষম মাত্রার ছন্দগুলি এর অন্তর্গত। এই শাখার প্রচলিত নাম ‘মাত্রাবৃত্ত’। পরবর্তী অংশে আলোচিত শিখরিণী প্রভৃতি সংস্কৃত-ভাঙা ছন্দগুলিও এই শ্রেণীভুক্ত।