পাতা:ছন্দ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৬৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৪২
ছন্দ

 মোট কথা বলা যায় দুই এবং তিন সংখ্যাই বাংলার সকল ছন্দের মূলে। তার রূপের বৈচিত্র্য ঘটে যতিবিভাগের বৈচিত্র্যে এবং নানা ওজনের পংক্তিবিন্যাসে। এইরকম বিভিন্ন বিভাগের যতি ও পংক্তি নিয়ে বাংলায় ছন্দ কেবলি বেড়ে চলেছে।

 একসময়ে শ্রেণীবদ্ধ মাত্রা গুনে ছন্দ-নির্ণয় হত। বালক বয়সে একদিন সেই চোদ্দ অক্ষর মিলিয়ে ছেলেমানুষি পয়ার রচনা করে নিজের কৃতিত্বে বিস্মিত হয়েছিলুম।[১] তারপরে দেখা গেল কেবল অক্ষর গণনা করে যে-ছন্দ তৈরি হয় তার শিল্পকলা আদিম জাতের। পদের নানা ভাগ আর মাত্রার নানা সংখ্যা দিয়ে ছন্দের বিচিত্র্য অলংকৃতি। অনেক সময়ে ছন্দের নৈপুণ্য কাব্যের মর্যাদা ছাড়িয়ে যায়।

 চলতিভাষার কাব্য, যাকে বলে ছড়া, তাতে বাংলার হসন্তসংঘাতের স্বাভাবিক ধ্বনিকে স্বীকার করেছে। সেটা পয়ার হলেও অক্ষরগোনা পয়ার হবে না, সে হবে মাত্রাগোনা পয়ার। কিন্তু কথাটা ঠিল হল না, বস্তুত সাধুভাষার পয়ারও মাত্রাগোনা। সাহিত্যিক কবুলতিপত্রে সাধুভাষায় অক্ষর এবং মাত্রা এক পরিমাণের বলে গণ্য হয়েছে। এই মাত্র রফা হয়েছে যে, সাধুভাষার পদ্য উচ্চারণকালে হসন্তের টানে শব্দগুলি গায়ে গায়ে লেগে যারে না, অর্থাৎ বাংলার স্বাভাবিক ধ্বনির নিয়ম এড়িয়ে চলতে হবে।

সতত হে নদ তুমি পড় মোর মনে।
জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে।[২]

চলতি বাংলায় ‘নদ’ আর ‘তুমি’, ‘মোর’ আর ‘মনে’ হসন্তের বাঁধনে বাঁধা। এই পয়ারে ঐ শব্দগুলিকে হসন্ত বলে যে মানা হয়নি তা নয়,

  1. দ্রষ্টব্য: জীবনস্মৃতি, কবিতা-রচনারম্ভ।
  2. মধুসুদন: চতুর্দশপদী কবিতাবলী, কপোতাক্ষ নদ।