পাতা:ছন্দ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৫১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২২৪
ছন্দ

কেবল অর্থবান্ তা নয়, ধ্বনিমান্‌ও বটে। নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে, এই গদ্যমন্ত্রের সার্থকতা অনেকে মনের ভিতর অনুভব করেছেন কারণ তার ধ্বনি থামলেও অনুরণন থামে না।[১]

 একদা কোনো এক অসতর্ক মুহূর্তে আমি আমার গীতাঞ্জলি ইংরেজি গদ্যে অনুবাদ করি। সেদিন বিশিষ্ট ইংরেজ সাহিত্যকেরা আমার অনুবাদকে তাঁদের সাহিত্যের অঙ্গস্বরূপ গ্রহণ করলেন। এমন কি ইংরেজি গীতাঞ্জলিকে উপলক্ষ্য করে এমন সব প্রশংসাবাদ করলেন যাকে অত্যুক্তি মনে করে আমি কুণ্ঠিত হয়েছিলাম। আমি বিদেশী, আমার কাব্যে মিল বা ছন্দের কোনো চিহ্নই ছিল না, তবু যখন তাঁরা তার ভিতর সম্পূর্ণ কাব্যের রস পেলেন, তখন সে-কথা তো স্বীকার না করে পারা গেল না। মনে হয়েছিল ইংরেজি গদ্যে আমার কাব্যের রূপ দেওয়ায় ক্ষতি হয়নি, বরঞ্চ পদ্যে অনুবাদ করলে হয়তো তা ধিক্‌ক্বত হত, অশ্রদ্ধেয় হত।[২]

 মনে পড়ে একবার শ্রীমান্ সত্যেন্দ্রকে বলেছিলুম, “ছন্দের রাজা তুমি, অ-ছন্দের শক্তিতে কাব্যের স্রোতকে তার বাঁধ ভেঙে প্রবাহিত কর দেখি।” সত্যেনের মতো বিচিত্র ছন্দের স্রষ্টা বাংলায় খুব কমই আছে। হয়তো অভ্যাস তাঁর পথে বাধা দিয়েছিল, তাই তিনি আমার প্রস্তার গ্রহণ করেননি। আমি স্বয়ং এই কাব্য রচনার চেষ্টা করেছিলুম লিপিকায়, অবশ্য পদ্যের মতো পদ ভেঙে দেখাইনি। লিপিকা লেখার পর বহুদিন আর গদ্যকাব্য লিখিনি। বোধ করি সাহস হয়নি বলেই।[৩]

 কাব্যভাষার একটা ওজন আছে, সংযম আছে, তাকেই বলে ছন্দ। গদ্যের বাছবিচার নেই, সে চলে বুক ফুলিয়ে। সেজন্যেই রাষ্ট্রনীতি প্রভৃতি প্রাত্যহিক ব্যাপার প্রাঞ্জল গদ্যে লেখা চলতে পারে। কিন্তু

  1. তুলনীয়: যজুর্বেদের গদ্যমন্ত্রের...থেকে বার পৃ ১৫৩।
  2. দ্রষ্টব্য পৃ ২১৮ পাদটীক। ১।
  3. দ্রষ্টব্য পৃ ২১৮ পাদটীক। ১।