পাতা:ছন্দ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ছন্দের হসন্ত হলন্ত
৫৫

অথচ সেদিন ‘বৃত্রসংহারে’ এইজাতীয় ছন্দে হেমচন্দ্র ঐন্দ্রিলার রূপবর্ণনায় অসংকোচে লিখতে পেরেছিলেন

বদনমণ্ডলে ভাসিছে ব্রীড়া।

 বেশ মনে আছে সেদিন স্থানবিশেষে ‘ঐ’ শব্দের বানান নিয়ে আমাকে ভাবতে হয়েছিল। প্রবোধচন্দ্র নিশ্চয় বলবেন, “ভেবে যা হয় একটা স্থির করে ফেলাই ভালো ছিল। কোথাও বা ‘ঐ’, কোথাও বা ‘ওই’ বানান কেন।” তার উত্তর এই বাংলার স্বরের হ্রস্বদীর্ঘতা সংস্কৃতের মতো বাঁধা নিয়ম মানে না, ওর মধ্যে অতি সহজেই বিকল্প চলে। “ও—ই দেখ, খোকা ফাউনটেন পেন মুখে পুরেছে”, এখানে দীর্ঘ ওকারে কেউ দোষ ধরবে না। আবার যদি বলি “ঐ দেখ, ফাউনটেন পেনটা খেয়ে ফেললে বুঝি”, তখন হ্রস্ব ঐকার নিয়ে বচসা করবার লোক মিলবে না। বাংলা উচ্চারণে স্বরের ধ্বনিকে টান দিয়ে অতি সহজেই বাড়ানো-কমানো যায় বলেই ছন্দে তার গৌরব বা লাঘব নিয়ে আজ পর্যন্ত দলাদলি হয়নি।  এ সব কথা দৃষ্টান্ত না দিলে স্পষ্ট হয় না, তাই দৃষ্টান্ত তৈরি করতে হল।

মনে পড়ে দুইজনে জুঁই তুলে বাল্যে
নিরালায় বনছায় গেঁথেছিনু মাল্যে।
দোঁহার তরুণ প্রাণ বেঁধে দিল গন্ধে
আলোয় আঁধারে মেশা নিভৃত আনন্দে।

এখানে ‘দুই’ ‘জুঁই’ আপন আপন উকারকে দীর্ঘ করে দুই সিলেব্‌ল্এর টিকিট পেয়েছে, কান তাদের সাধুতায় সন্দেহ করলে না, দ্বার ছেড়ে দিলে। উলটো দৃষ্টান্ত দেখাই।

এই যে এল সেই আমারি স্বপ্নে দেখা রূপ,
কই দেউলে দেউটি দিলি, কই জ্বালালি ধূপ।
যায় যদি রে যাক না ফিরে চাইনে তারে রাখি,
সব গেলেও হায়রে তবু স্বপ্ন রবে বাকি।