পাতা:ছিন্নপত্র-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৫১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

শিলাইদহ,

১১ই মে, ১৮৯৩।

 কাল বিকেলের দিকে খুব ঘনঘটা করে মেঘ করে খানিকটা বৃষ্টি হয়ে আবার পরিষ্কার হয়ে গেছে। আজ খানকতক দলভ্রষ্ট বিচ্ছিন্ন মেঘ সূর্য্যালোকে শুভ হয়ে খুব নিরীহ নিরপরাধভাবে আকাশের ধারে ধারে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেখেত মনে হয় এদের বর্ষণের অভিপ্রায় কিছুমাত্র নেই। কিন্তু চাণক্য তাঁর সুবিখ্যাত শ্লোকে যাদের যাদের বিশ্বাস করতে নিষেধ করেচেন তার মধ্যে দেবতাকেও ধরা উচিত ছিল। আজ সকালবেলাটি বড় সুন্দর হয়ে উঠেছে—আকাশ পরিষ্কার নীল, নদীর জলে রেখামাত্র নেই এবং ভাঙার কাছে গড়ানে জায়গায় যে ঘাসগুলি হয়েচে তাতে পূর্ব্বদিনকার বৃষ্টির কণাগুলি লেগে সেগুলি ঝক্‌ঝক্‌ করচে। এই সমস্ত মিলে সূর্য্যালোকে আজকের প্রকৃতিকে ভারি একটি শুভ্রবসনা মহিমময়ী মহেশ্বরীর মত দেখাচ্চে। সকালবেলাটি এমনি নিস্তব্ধ হয়ে রয়েছে। কেন জানিনে নদীতে একটি নৌকো নেই, বোটের নিকটবর্ত্তী ঘাটে কেউ জল নিতে কেউ স্নান করতে আসেনি, নায়েব সকাল সকাল কাজ সেরে চলে গেছে। খানিকটা চুপ করে কানপেতে থাক্‌লে কি একটা ঝাঁ ঝাঁ শব্দ শোনা যায় এবং এই রৌদ্রালোক আর আকাশ আস্তে আস্তে প্রবেশ করে মাথার ভিতরটি একেবারে ভরে ওঠে এবং সেখানকার সমুদয় ভাব ও চিন্তাগুলিকে একটি নীল সোনালী রঙে রঙিয়ে দেয়। বোটের একপাশে একটা বাঁকা কৌচ আনিয়ে রেখেছি, এইরকম সকালবেলায় তার মধ্যে শরীরটা ছড়িয়ে দিয়ে সমস্ত কাজ ফেলে চুপচাপ করে পড়ে থাক্‌তে ইচ্ছে করে, মনে হয়

—“নাই মোর পূর্ব্বাপর,
যেন আমি একদিনে উঠেছি ফুটিয়া
অরণ্যের পিতৃমাতৃহীন ফুল!”—

যেন আমি এই আকাশের, এই নদীর, এই পুরাতন শ্যামল পৃথিবীর। বোটে আমার