পাতা:ছিন্নপত্র-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২০৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শিলাইদ ১৯শে আগষ্ট ১৮৯৪ । এবারে আমার সঙ্গে আমি রামমোহন রায়ের বাংলা গ্রন্থাবলী এনেছি। তাতে গুটি তিনেক সংস্কৃত বেদান্তগ্রন্থ ও তার অনুবাদ আছে । তার থেকে আমার অনেক সাহায্য হয়েছে । বেদান্তপাঠে বিশ্ব এবং বিশ্বের আদিকারণ সম্বন্ধে অনেকেই নিঃসংশয় হয়ে থাকেন কিন্তু আমার সংশয় দূর হয় না । এক হিসাবে অন্য অনেক মত অপেক্ষ বেদান্তমত সরল । স্বষ্টি ও স্বষ্টিকৰ্ত্ত কথাটা শুনতে সহজ কিন্তু আমন সমস্ত আর নেই । বেদান্ত তারি একেবারে গর্ড্যন-গ্রন্থি ছেদন করে বসে আছেন—সমস্যাটাকে একেবারে আধখানা ছেঁটেই ফেলেছেন। স্বষ্টি একেবারেই নেই, আমরাও নেই, আছেন কেবল ব্ৰহ্ম, আর মনে হচ্চে যেন আমরা আছি। আশ্চৰ্য্য এই মানুষ মনে একথা স্থান দিতে পারে, আরও আশ্চৰ্য্য এই কথাটা শুনতে যত অসঙ্গত আসলে তা নয়— বস্তুত কিছুই যে আছে সেইটে প্রমাণ করাই শক্ত। যাই হোক আজকাল সন্ধ্যাবেলায় যখন জ্যোৎস্না ওঠে এবং আমি যখন অৰ্দ্ধনিমীলিত চোখে বোটের বাইরে কেদারায় পা ছড়িয়ে বসি, স্নিগ্ধ সমীরণ আমার চিন্তাক্লান্ত তপ্ত ললাট স্পর্শ করতে থাকে তখন এই জলস্থল আকাশ, এই নদীকল্লোল, ডাঙার উপর দিয়ে কদাচিৎ এক আধজন পথিক ও জলের উপর দিয়ে কদাচিৎ এক আধখানা জেলে ডিঙির গতায়াত, জ্যোৎস্নালোকে অপরিস্ফুট মাঠের প্রান্ত, দূরে অন্ধকারজড়িত বনবেষ্টিত সুপ্তপ্রায় গ্রাম, সমস্তই ছায়ারই মত মায়ারই মত বোধ হয় অথচ সে মায়া সত্যের চেয়ে বেশি সত্য হয়ে জীবনমনকে জড়িয়ে ধরে, এবং এই মায়ার হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়াই যে মুক্তি এ কথা কিছুতেই মনে হয় না । দার্শনিক বলতে পারেন, জগৎটাকে সত্যজ্ঞান করাতে দিনের বেলায় যে একটা দৃঢ় বন্ধনজাল থাকে সন্ধ্যাবেলায় সমস্ত ছায়াময় ও সৌন্দৰ্য্যময় হয়ে আসাতে সেই বন্ধন অনেকট পরিমাণে শিথিল হয়ে আসে। যখন জগৎটাকে একেবারে নিছক মায় বলেই নিশ্চয় জাম্ব তখনি মুক্তির বাধা থাকৃবে না । এ কথাটা আমি অতি ঈ—ষৎ অনুমান এবং অনুভব করতে পারি—হয়ত কোন-দিন দেখুব বৃদ্ধবয়সের পূৰ্ব্বে আমি জীবন্মুক্ত হয়ে বসে আছি ।