পাতা:ছিন্নপত্র-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

( ৪২ )

জলস্থলের অধিকার নির্দ্দিষ্ট হয়ে যায়নি। চারিদিকে জেলেদের বাঁশ পোতা—জেলেদের জাল থেকে মাছ ছোঁ মেরে নেবার জন্যে চিল উড়চে, পাঁকের উপরে নিরীহ বক দাঁড়িয়ে আছে—নানারকমের জলচর পাথী—জলে শ্যাওলা ভাস্‌চে—মাঝে মাঝে পাঁকের মধ্যে অযত্নসম্ভূত ধানের গাছ, স্থির জলের উপর ঝাঁকে ঝাঁকে মশা উড়চে। ভোরের বেলা বোট ছেড়ে দিয়ে কাঁচিকাঠায় গিয়ে পড়া গেল। একটি বারো তেরো হাত সঙ্কীর্ণ খালের মত, ক্রমাগত এঁকে বেঁকে গেছে—সমস্ত বিলের জল তারি ভিতর দিয়ে প্রবল বেগে নিষ্ক্রান্ত হচ্চে—এর মধ্যে আমাদের এই প্রকাণ্ড বোট নিয়ে বিষম কাণ্ড—জলের স্রোত বিদ্যুতের মত বোটটাকে টেনে নিয়ে যাচ্চে, দাঁড়িরা লগি হাতে করে সাম্‌লাবার চেষ্টা করচে, পাছে ডাঙার উপর বোটটাকে আছ্‌ড়ে ফেলে। এদিকে হু হু করে বাদলার বাতাস দিচ্চে, ঘন মেঘ করে রয়েছে, মাঝে মাঝে বৃষ্টি হচ্চে, শীতে সবাই কাঁপচে। ক্রমে খোলা নদীতে এসে পড়লুম। শীতকালে মেঘাচ্ছন্ন ভিজে দিন ভারি বিশ্রী লাগে। সকালবেলাটা তাই নিতান্ত নির্জ্জীবের মত ছিলুম। বেলা দুটোর সময় রোদ্ উঠল। তার পর থেকে চমৎকার। খুব উঁচু পাড়ে বরাবর দুই ধারে গাছপালা লোকালয় এমন শান্তিময়, এমন সুন্দর, এমন নিভৃত—দুই ধারে স্নেহসৌন্দর্য্য বিতরণ করে নদীটি বেঁকে বেঁকে চলে গেছে—আমাদের বাংলাদেশের একটি অপরিচিত অন্তঃপুরচারিণী নদী। কেবল স্নেহ এবং কোমলতা এবং মাধুর্য্যে পরিপূর্ণ। চাঞ্চল্য নেই, অথচ অবসরও নেই। গ্রামের যে মেয়েরা ঘাটে জল নিতে আসে, এবং জলের ধারে বসে বসে অতি যত্নে গামছা দিয়ে আপনার শরীরখানি মেজে তুল্‌তে চায় তাদের সঙ্গে এর যেন প্রতিদিন মনের কথা এবং ঘরকন্নার গল্প চলে।

 আজ সন্ধ্যাবেলায় নদীর বাঁকের মুখে ভারি একটি নিরালা জায়গায় বোট লাগিয়েছে। পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে, জলে একটিও নৌকা নেই—জ্যোৎস্না জলের উপর ঝিকঝিক করচে—পরিষ্কার রাত্রি—নির্জ্জন তীর—বহুদূরে ঘনবৃক্ষবেষ্টিত গ্রামটি সুষুপ্ত— কেবল ঝিঁ ঝিঁ ডাক্‌চে আর কোন শব্দ নেই।