পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/১০৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জননী
১০৫

গেল না। যথাসময়ে শঙ্কর চলিয়া গেল সেই শীতল পাহাড়ী দেশে, এখানে বিধানের দেহ গরমে ঘামাচিতে ভরিয়া গেল।

 মনে মনে শ্যামা বড় কষ্ট পাইল। অভাব অনটনের অভিজ্ঞতা জীবনে তাহার পুরানো হইয়া আসিয়াছে। এমন দিনও তো গিয়াছে যখন সে ভাল করিয়া দেহের লজ্জাও আবরণ করিতে পারে নাই। কিন্তু আজ পর্যন্ত চারটি সন্তানের কোন বড় সাধ শ্যামা অপূর্ণ রাখে নাই—আকাশের চাঁদ চাহিবার সাধ নয়, শ্যামার ছেলেমেয়ে অসম্ভব আশা রাখে না। শ্যামার মত গরীবের পক্ষে পূরণ করা হয়ত কিছু কঠিন এমনি সব সাধারণ আব্দার। বিধান একবার সাহেবি পোষাক চাহিয়াছিল, তাদের ক্লাশের পাঁচ ছ’টি ছেলে যে রকম বেশ পরিয়া স্কুলে আসে। দোতালার ঘরের জন্য ইঁট সুরকি কিনিয়া শ্যামা তখন ফতুর হইয়া গিয়াছে। তবু ছেলেকে পোষাক তো সে কিনিয়া দিয়াছিল।

 শ্যামার চোখে আজকাল সব সময় একটা ভীরুতার আভাস দেখিতে পাওয়া যায়। শীতলের উপরেও কোনদিন সে নিশ্চিন্ত নির্ভর বাখিতে পারে নাই। কমল প্রেসের চাকরীতে শীতল যখন ক্রমে ক্রমে উন্নতি করিতেছিল তখনও নয়। তবু তখন মনে যেন তাহার একটা জোর ছিল। আজ সে জোর নষ্ট হইয়া গিয়াছে। চোরের বৌ? জীবনে এ ছাপ তাহার ঘুচিবে না, স্বামীর অপরাধে মানুষ তাহাকে অপরাধী করিয়াছে। কেহ বিশ্বাস করিবে না, কেহ সাহায্য দিবে না, সকলেই তাহাকে পরিহার করিয়া চলিবে। যদি প্রয়োজনও হয়, ছেলেমেয়েদের দু বেলার আহার সংগ্রহ করিবার সঙ্গত উপায় খুঁজিয়া পাইবে না। বন্ধুবান্ধব আত্মীস্বজন সকলে যাহাকে এড়াইয়া চলিতে চায়, নিজের পায়ে ভর দিয়া দাঁড়াইবার চেষ্টা সে করিবে কিসের ভরসায়? বিধবা হইলেও সে বোধ হয় এতদূর নিরুপায় হইত না। দু বছর পরে শীতল হয়ত ফিরিয়া আসিবে, হয়ত আসিবে না। আসিলেও শ্যামার দুঃখ সে কি লাঘব করিতে পারিবে? নিজের প্রেস বিক্রয় করিয়া কতকাল শীতল অলস অকর্মণ্য হইয়া বাড়ি বসিয়াছিল সে ইতিহাস শ্যামা ভোলে নাই। তবু তখন শীতলের বয়স কম ছিল, মন তাজা ছিল। এই বয়সে দু’বছর জেল খাটিয়া আসিয়া আর কি সে এত বড় সংসারের ভার গ্রহণ করিতে পারিবে?