পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/১১৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জননী
১১৫

দিয়াছিল তাহা মলিন বিবর্ণ হইয়া গিয়াছে। এক বছরে কারো বয়স এক বছরের বেশি বাড়ে না, শ্যামারও বাড়ে নাই, কিন্তু তাহাকে দেখিয়া কে তাহা ভাবিতে পারিবে। গত যে বসন্ত ব্যর্থ গিয়াছে, তার আগেরটি উতলা করিয়াছিল কোন্ শ্যামাকে? বনগাঁয়ে এই যে শীর্ণা নিষ্প্রভজ্যোতি শ্রান্ত নারীটি আসিয়াছে, শহরতলীর সেই বাড়িটির দোতালায় সমাপ্তপ্রায় নতুন ঘরটির ছায়ায় দাঁড়াইয়া বসন্তের বাতাসে ধানকলের ছাই উড়িতে দেখিয়া জেলের কয়েদী স্বামীর জন্য এরই যৌবন কি ক্ষোভ করিয়াছিল?

 শেষের দিকে পরাণ ডাক্তার বারো টাকা ভাড়ায় একতলাতে একটি ভাড়াটে জুটাইয়া দিয়াছিল, সরকারী আফিসের এক কেরাণী, সম্প্রতি স্ত্রী ও শিশুপুত্র লইয়া দাদার সঙ্গে পৃথক হইয়া আসিয়াছে। কেরাণী বটে কিন্তু বড়ই তাহারা বিলাসী। হাঁড়ি কলসী, পুরানো লেপ-তোষক, ভাঙ্গা রঙচটা বাক্স প্রভৃতিতে শ্যামার ঘর ভরা থাকিত, ওরা আসিয়া ঝকঝকে সংসার পাতিয়া বসিল, জিনিসপত্র তাহাদের বেশি ছিল না কিন্তু যা ছিল সব দামী ও সুদৃশ্য। বৌটি শ্যামা শুনিল বড়লোকের মেয়ে, স্কুলেও নাকি পড়িয়াছিল, স্বাধীন ভাবে একটু ফিটফাট থাকিতে ভালবাসে—বড় ভাইএর সঙ্গে ওদের পৃথক হওয়ার কারণটাও তাই। পৃথক হইয়া বৌটি যেন বাঁচিয়াছে। নিজের সংসার পাতিতে কি তাহার উৎসাহ। পথের দিকে যে ঘরে শ্যামা আগে শুইত তার জানালায় জানালায় সে নতুন পর্দা দিল, চিকণ কাজ করা দামী খাটটি, বোধ হয় বিবাহের সময় পাইয়াছিল, দক্ষিণের জানালা ঘেঁসিয়া পাতিল, আয়না বসানো টেবিলটি রাখিল ঘরে ঢুকিবার দরজার সোজা অপর দিকের দেয়ালের কাছে। খাট টেবিল আর কাঠের একটি চেয়ার তাহার সমগ্র আসবাব, তাই যেন তার ঢের। ভাঁড়ারে তাকের উপর মসলাপাতি রাখিবার কয়েকটি নতুন চকচকে টিন, কাঁচের জার, ষ্টোভ, চায়ের বাসন আর দুটি একটি টুকিটাকি জিনিস রাখিয়া, রাখিবার আর কিছুই তাহার রহিল না, সমস্ত ঘরে একটি রিক্ত পরিচ্ছন্নতা ঝক ঝক করিতে লাগিল। সংসার করিতে করিতে একদিন হয় ত সে শ্যামার মতই ঘরবাড়ি জঞ্জালে ভরিয়া ফেলিবে, সুরুতে আজ সবই তাহার আনকোরা ও সংক্ষিপ্ত। বাড়াবাড়ি ছিল শুধু তাহাদের প্রেমের। এমন নির্লজ্জ নিবিড় প্রেম শ্যামা জীবনে আর দ্যাখে