পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/১২৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জননী
১২৫

ঘুরিতে থাকে। রাখালের সঙ্গে একদিন সে এ বিষয়ে পরামর্শ করিল। রাখালও বাড়িটা বিক্রি করার পরামর্শই দিল। বলিল, বাড়িভাড়া দিবার হাঙ্গামা কি সহজ। অর্ধেক বছর বাড়ি হয়ত খালিই পড়িয়া থাকিবে, ভাড়াটে জুটিলেও ভাড়া যে নিয়মিত পাওয়া যাইবে তারও কোন মানে নাই, একেবারে না পাওয়াও অসম্ভব নয়। তারপর বাড়ির পিছনে খরচ নাই? পুরানো বাড়ি, মাঝে মাঝে মেরামত করিতে হইবে, বছর বছর চুনকাম করিয়া না দিলে ভাড়াটে থাকিবে না—ড্রেন নেওয়া হইয়াছে শ্যামার বাড়িতে? এবার হয়ত ড্রেন না লইলে কর্পোরেশন ছাড়িবে না, সে অনেক খরচের কথা, শ্যামা কোথা হইতে খরচ করিবে?

 বাড়ি পোষা হাতী পোষার সমান বৌঠান, বাড়ি তুমি ছেড়ে দাও।

 বিধান রাত প্রায় এগারোটা অবধি পড়ে, বকুল মণি ওরা ঘুমাইয়া পড়ে অনেক আগে। সেদিন রাত্রে শ্যামা বিধানকে বলিল, খোকা, সবাই যে বাড়ি বিক্রি করে দিতে বলছে বাবা?

 বিধানের সঙ্গে শ্যামা আজকাল নানা বিষয়ে পরামর্শ করে, ভবিষ্যতের কত জল্পনা কল্পনা যে তাদের চলে তাহার অন্ত নাই। বিধান বলে, বড় হইয়া সে মস্ত চাকরি করিলে তারপর শঙ্করের মত একটা মোটর কিনিবে। শঙ্করের মোটর? শীতলের জেল হইবার পর শঙ্করের মোটরে তার যে স্কুলে যাওয়া বন্ধ হইয়াছিল সে অপমান বিধান কি মনে করিয়া রাখিয়াছে? রাত জাগিয়া তাই এত ওর পড়াশোনা? শীতলের কথা বিধান কখনো বলে না। পড়া শেষ করিয়া ছেলে শুইতে আসিলে শ্যামা কতদিন প্রতীক্ষা করিয়াছে, চুপি চুপি বিধান হয়ত জিজ্ঞাসা করিবে, বাবা কবে ছাড়া পাবে মা? কিন্তু কোনদিন বিধান এ প্রশ্ন করে না। যে তীব্র অভিমান ওর, হয়ত বাপের জেল হওয়ার লজ্জা ওকে মূক করিয়া রাখে। পরের বাড়ি তারা যে এভাবে পড়িয়া আছে, এজন্য বাপকে দোষী করিয়া মনে হয়ত ও নালিশ পূরিয়া রাখিয়াছে।

 আলোটা নিভাইয়া শ্যামা বিধানের মাথার কাছে লেপের মধ্যে পা ঢুকাইয়া বসে। একপাশে ঘুমাইয়া আছে বকুল মণি ও ফণী। এপাশে অবোধ বালক বুকে ক্ষোভ ও লজ্জা পূরিয়া এত রাত্রে জাগিয়া আছে। শ্যামা ছেলের বুকে একখানা হাত রাখে। বেড়ার ফুটা দিয়া জ্যোৎস্নার কতকগুলি রেখা