পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/১৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জননী
১৭

 শীতল কিছু বলে নাই। কি বলিবে?

 শ্যামা আবার বলিয়াছে, সেবার আমার দোষেই তাে গেল।

 শীতল একটু ভাবিয়া বলিয়াছে, এটার কিন্তু পয় আছে শ্যামা। হতে হতে কমল প্রেসের চাকরিটা পেলাম।

 বােলো না বাবু ওসব। পয় না ছাই। আগে বাঁচুক।

 কিন্তু কথাটা তুচ্ছ করিবার মত নয়। পয়মন্ত ছেলে? হয় তাে তাই। সব অকল্যাণ ও নিরানন্দের অন্ত করিতে আসিয়াছে হয় তাে। শ্যামা হয় তো আর দুঃখ পাইবে না।

 এরা সময় মত মাইনে দেবে?

 দেবে না? কমল প্রেস কত বড় প্রেস জানাে?

 এবার ছেলে তাহার বাঁচিবে শ্যামা যে এ আশা করে না এমন নয়। মানুষের আশা এমন ভঙ্গুর নয় যে একবার ঘা খাইলে চিরদিনের জন্য ভাঙ্গিয়া পড়িবে। তবু আশাতেই আশঙ্কা বাড়ে। সব শিশুই যদি মরিয়া যাইত পৃথিবীতে এতদিনে তবে আর মানুষ থাকিত না, শ্যামার এই পুরানো যুক্তিটাও এবার হইয়া গিয়াছে বাতিল। সংসারে এমন কত নারী আছে যাদের সন্তান বাঁচে না। সেও যে তাদের মত নয় কে তাহা বলিতে পারে? একে একে পৃথিবীতে আসিয়া তাহার ছেলেমেয়েরা কেউ বারােদিন কেউ ছ'মাস বাঁচিয়া যদি মরিয়া যাইতে থাকে। বলা তাে যায় না। এমনি যাদের অদৃষ্ট তাদের এক একটি সন্তান দশ-বারাে বছর টিঁকিয়া থাকিয়া হঠাৎ একদিন মরিয়া যায়, এরকমও অনেক দেখা গিয়াছে। হালদার বাড়ির বড়বৌ দুবার মৃতসন্তান প্রসব করিয়াছিল, তার পরের সন্তান দুটি বাঁচিয়া ছিল বছরখানেক। শেষে যে মেয়েটা আসিয়াছিল তাহার বিবাহের বয়স হইয়াছিল। কি আদরেই মেয়েটা বড় হইয়াছিল! তবু তাে বাঁচিল না।

 নৈসর্গিক প্রতিবিধানের ব্যবস্থা এবার কম করা হয় নাই। শ্যামা গােটা পাঁচেক মাদুলি ধারণ করিয়াছে, কালীঘাট ও তারকেশ্বরে মানত করিয়াছে পূজা। মাদুলিগুলির মধ্যে তিনটি বড় দুর্লভ মাদুলি। সংগ্রহ করিতে শ্যামাকে কম বেগ পাইতে হয় নাই। মাদুলি তিনটির একটি প্রসাদী ফুল, একটিতে সন্ন্যাসীপ্রদত্ত ভষ্ম ও অপরটিতে স্বপ্নাদ্য শিকড় আছে।