পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৬৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জননী
৬৩

 বেশ করেছ। যেমন করে আফিসে চলে গেলে, মামা না জানি কি ভেবেছিল!

 শীতল ইতস্তত করে, কি যেন সে বলিবে মনে করিয়াছে। সে একটা পান খায়। শ্যামার মুখের দিকে চাহিয়া মনে মনে কি সব হিসাব করে। হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিল, মামা ক’দিন থাকবেন এখন, না?

 শ্যামা বলিল, ক’দিন কেন? বরাবর থাকবেন, আমরা থাকতে বুড়ো বয়সে হোটেলের ভাত খেয়ে মববেন কি জন্যে?

 আমিও তাই বলছিলাম। পয়সা কড়ি কিছু করেছেন মনে হয় এ্যাঁ?

 মনে তো হয়, এখন আমাদের অদেষ্ট!

 মামা একটা ঘুম দিয়া উঠিলে বিকালে তাহারা চারিদিকে ঘেঁষিয়া বসিয়া গল্প শুনিতে লাগিল, শহর গ্রাম অরণ্য পর্বতের গল্প রাজা-মহারাজা সাধু সন্ন্যাসী চোর ডাকাতের গল্প, রোমাঞ্চকর বিপদ আপদের গল্প। মামা কি কম দেশ ঘুরিয়াছে, কম মানুষের সঙ্গে মিশিয়াছে। সুদূর এবটা তীর্থের নাম কর, যার নামটি মাত্র শ্যামা ও শীতল শুনিয়াছে, যেমন রামেশ্বর সেতুবন্ধ, নাসিক বদরীনাথ—মামা সঙ্গে সঙ্গে পথের বর্ণনা, দেয় তীর্থের বর্ণনা দেয়, সব যেন রূপ ধরিয়া চোখের সামনে ফুঁটিয়া ওঠে। সেই বিধবা সঙ্গিনীটি কতকাল আমার সঙ্গে ছিল কেহ জিজ্ঞাসা করিতে পারে না, মামার যাযাবর জীবনের ইতিবৃত্ত শুনিয়া কিন্তু মনে হয় চিরকাল সে দেশে দেশে ঘুরিয়াছে একা, সাথী যদি কখনো পাওয়া গিয়া থাকে, সে পথের সাথী—পুরুষ। শ্যামা একবার সুকৌশলে জিজ্ঞাসা করে গ্রাম হইতে বাহির হইয়া প্রথমে মামা কোথায় গিয়াছিল, মামা সোজাসুজি জবাব দেয়, কাশী,—কাশীতে ছিলাম পাঁচ ছ'টা মাস, ভুলে টুলে গিয়েছি সে সব বাপু, সে কি আজকের কথা।

 শ্যামা বলে, একা একা ঘুরে বেড়াতে ভাল লাগত মামা?

 মামা বলে, একা ঘুরেই তো সুখ রে, ভাবনা নেই চিন্তা নেই, যখন যেখানে খুশি পড়ে থাক, যেখানে খুশি চলে যাও, কারো তোয়াক্কা নেই, জুটলো খেলে না জুটলো উপোস করলে—চিরকাল ঘরের কোণে কাটালি, সে আনন্দ তোরা কি বুঝবি? একবার কি হল,—নীলগিরি পাহাড়ের গোড়ায় একটা গ্রামে গিয়েছি এক সাধুর সঙ্গে, গ্রামটার নাম বুঝি তুড়িগোড়িয়া,