পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৯৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৯২
জননী

 বাড়িতেও তো আসতে পারে, তবে এক আধ ঘণ্টার জন্যে?

 না তা পাবে না,—জেলের বাইরে যেতে আসতে দেয়, দুদণ্ড দাঁড়িয়ে এর ওর সঙ্গে কথা বলতে দেয়, তাই বলে নজর কি রাখে না একেবারে? তাছাড়া কয়েদীর পোষাক পরে কোথায় যাবে?—কেউ ধরে এনে দিলে তো শেষ পর্যন্ত দাঁড়াবে পালিয়ে যাচ্ছিল।— আবাব দেবে ছ’মাস ঠুকে। জেলের কাণ্ডকারখানার কথা আর বলিসনে শ্যামা, মজার জায়গা জেল—শীতল যত কষ্ট পাবে ভাবছিস তা সে পাবে না, ওই প্রথম দিকে একটু যা মনের কষ্ট।

 উৎসাহের সঙ্গে গড়গড় করিয়া মামা বলিয়া যায় অবাধ অকুণ্ঠ। কত অভিজ্ঞতাই জীবনে মামা সংগ্রহ করিয়াছে।

 শ্যামা সজল চোখে বলিয়াছিল, এত খবরও তুমি জান মামা। তুমি না থাকলে কি যে করতাম আমি—ভেবে ভেবে পাগল হয়ে যেতাম।—বছরে ক’মাস কয়েদ মকুব করে মামা? ভাল হয়ে থাকলে বোধ হয় শীগগির ছেড়ে দেয়। একদিন গিয়ে দেখা করে বলে আসব, ভাল হয়েই যেন থাকে।

 পাড়ায় ব্যাপারটা জানজানি হইয়া গিয়াছে। পাড়ার যেসব বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে শ্যামার জানাশোনা ছিল, শ্যামার সঙ্গে তাহাদের ব্যবহারও গিয়াছে সঙ্গে সঙ্গে বদলাইয়া। কেহ সহানুভূতি দেখায় নীরবে ও সরবে: কেহ কোন রকম অনুভূতিই দেখায় না বিস্ময় সমবেদনা অবহেলা কিছুই নয়। পাড়ার নকুড়বাবুর পরিবারের সঙ্গে শ্যামার ঘনিষ্ঠতা ছিল বেশি এখন ওদের বাড়ি গেলে ওরা বসিতে বলিতে ভুলিয়া যায়, সংসারের কাজের চেয়ে শ্যামার দিকে নজর একটু বেশি দিতে মনে থাকে না। কথা বলিতে বলিতে ওদের কেমন উদাস বৈরাগ্য আসে। কত যেন শ্রান্ত ওরা। চোয়াল ভাঙিয়া এখুনি হাই উঠিবে। শ্যামার বাড়িতে যারা বেড়াইতে আসিত, তাদের মধ্যে তারাই শুধু আসা যাওয়া সমানভাবে বজায় রাখিয়াছে। এমন কি বাড়াইয়াও দিয়াছে। যারা আসিলে শ্যামার সম্মান নাই, না আসিলে নাই অপমান।

 বিধান এতকাল শঙ্করের সঙ্গে বাড়ির গাড়িতে স্কুলে গিয়াছে, একদিন দশটার সময় বই-খাতা লইয়া বাহির হইয়া গিয়া খানিক পরে সে আবার ফিরিয়া আসিল। শ্যামা জিজ্ঞাসা করিল, স্কুলে গেলি নে?

 শঙ্করকে নিয়ে গাড়ি চলে গেছে মা।