পাতা:জীবনানন্দ সমগ্র (তৃতীয় খণ্ড).pdf/১২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দুপুর বাঁশের ঝাড়ের কাছে বসে কচ্ছপের খোলা চিবোয় হয়তো সমস্ত দিন কুই কুই করে একা-একা ঘুরে বেড়ায় হয়তো... কোনো কাজ লেই, দাম নেই, উপায় যখন একা সাখীহীন হয়ে পড়ে তখন নিঃসঙ্গ মানুষের চেয়েও ঢের বেশি কষ্ট তার। কে জানে কেতু বেঁচেই-বা আছে কি না ? এক-এক দিন গোলদিঘিতে ঘুরে-ঘুরে ঘুরে-ঘুরে অবসন্ন হয়ে রাত্তির বেলা বিছানায় এসে শুয়ে প্রভাতের মনে হয় দেশের বাড়িতে এতক্ষণে মা-র সঙ্গে আর কমলার সঙ্গে কথা বলে নিস্তার পেয়ে বঁাচত সে ; কিংবা নিরঞ্জনকে নিয়ে অশ্বথগাছের কাছে আমরুল আর ঘাসে ঢাকা বাধানো পৈঠার উপর বসে রক্তাক্ত সংগ্রাম থেকে ছুটি ಜಸ್ 13 ও নরম অন্ধকারের মতো শান্তি ও আশ্বাসে পাড়াগার মা-র চিঠিতে খবর পেয়েছে প্রভাত, যে, উষা দেশে এসেছে, প্রভাতদের পাশের বাড়ির অক্ষয়বাবুর মেয়ে উষা আহা, সে এসেছে। আবাল্য তার সঙ্গে মুখের আলাপ রাখে নি কোনোদিন প্রভাত, এমনই লাজুক। কিন্তু কত দিন ধরে এই মেয়েটিকে দেখে এসেছে প্রভাত নম্র, স্নিগ্ধ, বিচক্ষণ, নিঃশব্দ। অন্ধকার রাতে কাঠাল-হিজলের জঙ্গলের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকতে যেমন ভালো লাগে—এই মেয়েটিকেও তেমনি লাগে— দু-তিন বছর পরে উষা দেশে ফিরল—অথচ এই সময়ে নিজে সে দেশে থাকতে পারল না। রাতে গান গাওয়ার অভ্যাস এই মেয়েটির—রোজ রাতেই সে গায় ; কেমন গভীর আত্মনিবেদন আত্মসমর্পণের গান—নারীর সজীব সাধক হৃদয়ের থেকে উচ্ছিত হয়ে উঠেছে। তাই এমন নিবিড় ভাবে সরস। এবারও কি উষা গায় ? এখানে গভীর রাতে মেসের ঝি সৈরভীর গলা খনখন করে ওঠে—ম্যানেজারের সঙ্গে ঝগড়া না ইয়ার্কি ঠিক বুঝতে পারা যায় না। রাতের অনেক কটা মুহূর্ত—অনেক সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা এই কর্কশ বৈচিত্র্যহীন মূল্যহীন গলা নিজের ঢাক পিটিয়ে চলে। অবাক হয়ে ভাবে : জীবনের বিচিত্র নিয়ম—এমন রাতে। এক-এক দিন সন্ধ্যার সময় টালিগঞ্জের দিকে হাটতে-হাটতে দেশের শ্মশানের কথা মনে হয়—বাবার মঠের কাছে গিয়ে বসতে ইচ্ছে করে— চৈত্রের করুণ বাতাসের ভিতর দিয়ে কে আসে?—উড়ো শুকনো পাতা ? সুরকি? কাকর ? খড় ? হ্যা, বাবার গলাও যেন—সেই দূর শ্মশান থেকে যেন ডাকছেন “খোকা, তুমি আমার কাছে এসে একটু বোসো—আমি শান্তি পাই। কলকাতার পথে-পথে হতভাগা ছেলে তুমিই-বা কত দিন এই মনের অশান্তি নিয়ে কাটাবে? ১২৯