পাতা:জীবনানন্দ সমগ্র (তৃতীয় খণ্ড).pdf/১৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

প্রাইভেট ইস্কুলের; কিন্তু তবুও ইস্কুলের অবস্থা বিশেষ ভালো নয়; বাবাকে মাসে আশি টাকা করে দেয়। সত্তর বছরের বুড়ো মানুষ। ইস্কুল আমাদের বাসার থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে। গাড়ি চড়ে যান ? চড়েন কী বাবা ? তা যান না; যাবার উপায়ই-বা কোথায়? আশি টাকার। দেশের বাড়িতে পেটও অনেক; মানুষের নানারকম তাগিদ সেইখানে। বেতের আরাম কেদারায় বসে আছি। হ্যাভেনা চুরুটের নীল ধোঁয়া জানালা দিয়ে ধীরে-ধীরে বেরিয়ে যায়। রেলিঙের উপর রোদের ভিতর গোটাকয়েক চড়াই। সুটকেশগুলো বিক্রি করে ফেললেও হবে সব। নিজের কাজের জন্য একটা রেখে দেব শুধু গ্লাডস্টোন ব্যাগগুলো হোল্ড-অল, ট্রাঙ্ক, গোটা দশেকসুট বিক্রি করে কত পয়সা পাওয়া যাবে ? মনে-মনে একটা হিশেব করে নিই। এসব জিনিশ যারা কেনে বিক্রি করে কী লাভ ? জিনিশগুলোর ওপর মায়া ধরে যায়। কিন্তু দুপুরবেলাই বিক্রি করে বসলাম। বাড়ির জন্য ধুতি, শাড়ি, ছাতা, ফ্রক, ব্লাউজ কিনে যখন ট্রেনে উঠলাম, হাতে তখন পাঁচ টাকা সোয়া ছ-আনা পয়সা বাকি শুধু। হুইলারের স্টলের নভেলটা ধীরে-ধীরে খুলে পড়তে শুরু করি; কিন্তু আধ ঘণ্টা ধরে প্রথম প্যারাগ্রাফটাই পড়লাম শুধু—সাত লাইনের একটা প্যারা। বইটা বন্ধ করে রাখতে হয়; মাদ্রাজ যে খুব ভালো লেগেছিল তা নয়; কিন্তু কলকাতায় এসে কেমন একটা অবসাদ, চুরুটে একটা টান দেই। এখানেই ব্যবসা শুরু করব? না চাকরি খুঁজব ? যা হয় করা যাবে একটা কিছু। মনের ভিতর চিন্তা, স্বপ্ন, কোনো রং নেই এখন আর। কোনো তাড়া নেই। একটা নভেল আদি পড়তে ইচ্ছা করে না, দেশের বাড়িতে পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করে। সেই মস্তবড় সবুজ সতেজ লেবুগাছটা সেখানে সেই ছোট্ট কোণটুকুর ভিতর খাটের উপর মাদুর ফেলে শুরু থেকে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। তারপর ফাল্গুনের আমের বোলের গন্ধের ভিতর, দুপুরের বিবির ডাকে ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছা করে। নীলিমা হয়তো খাটের পাশে এসে বসবে—বেশ ভালো কথা; স্নান হয়ে গেছে, স্নিগ্ধ নারকেল-তেল মাখা ঠাণ্ডা চুল; খাওয়াদাওয়া শেষ হয়েছে। হাতে কয়েক গাছা সোনার চুড়ি মিন্ধ জলের ভিতর চাদের আলোর মতো ঝিলমিল করছে। হয়তো সে একা-একা বসবে না। খুকিকে এনে আমার বালিশের পাশে বসিয়ে দেবে কিংবা খুকি একা আসবে, সমস্তটা দুপুর আমার খাটে তার কাজ। কিংবা মা আসবেন। খুনসুড়ি, খেলা, ঘুম, করুণ নিবেদন, ঠোঁট ফুলিয়ে কান্না, তৃপ্তি। সন্ধ্যার পর বাবার সঙ্গে বসে কথাবার্তা বলা যাবে অনেক রাত অদি। বাবা কতকগুলো বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলতে খুব ভালোবাসেন; আত্মা-অমরতা, ভগবান, ধর্ম, থিয়জফি, হিন্দু মিশন, এডুকেশন ও নানারকম সাহিত্য, উপন্যাস কবিতা। একখানা নতুন ইংরেজি নভেল যদি বাবাকে দেওয়া যায় ভারী প্রসন্ন হন তিনি; অমনি চশমা লাগিয়ে সন্ধ্যার আবছায়ার ভিতর বিনা লণ্ঠনেই পড়তে শুরু করে দেন; >8S)