পাতা:জীবনানন্দ সমগ্র (তৃতীয় খণ্ড).pdf/৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

জেনেছি, বুঝেছি,সব লিখেছি, তখন ঘুমিয়ে পড়া যাক, অন্ধকার বেড়ে চলুক, কোনোদিনও যেন এই অন্ধকার শেষ হয় না, ঘুম কোনোদিনও ফুরোয় না যেন আর।' —আর কী-রকম চিন্তা করো ? ‘. চুপ করে ছিলাম। —‘এই সৃষ্টিটাকে একটা পাখির খাচার মতো তৈরি করে নিতে পারা যায়, তখন মানুষের অবস্থা বড় ভয়াবহ হয়ে ওঠে। আমার অনেক সময় মনে হয় জীবনটা কলে ধরা ইদুরের মতো। যেন চারদিকে শিক আর শিকল শুধু—না আছে রাপ না আছে ফুর্তি—” বাবা বিশেষ গ্রাহ্য না করে বললেন—দুপুরবেলা কী করো ? মেসে থাকো ? —আগে থাকতাম না, আগে বড় নিবোধ ছিলাম।” —‘কী রকম ? —‘মেসের বিছানায় একা-একা শুয়ে থাকতে বড় খারাপ লাগত। —‘একা-একা?” —‘হ্যা। সবাই অফিসে চলে যায়; অফিসারদের মেস, সকলেই কোথাও-না কোথাও কাজ করে—জীবনের জবাবদিহি দেয়, জীবনের কাছ থেকে পুরস্কার পায়। এই সব অনেক দিন ভেবে-ভেবে বিছানায় আর শুয়ে থাকতে পারি না আমি। মনে হত বেরিয়ে গেলে আমিও হয়তো সৃষ্টির কাছে নিজের জীবনের কৈফিয়ৎ দেবার সুযোগ বের করে নিতে পারব।” —কিন্তু আজকাল বেরোও না বুঝি আর ? —নাঃ’, একটু হেসে বললাম, অবাক হয়ে ভাবি, জীবনের চার-পাঁচটা বছর ধরে সমস্তটা দুপুর কলকাতা শহরের কত জায়গায় টো-টো করে বেড়িয়েছি।ইউনিভার্সিটি বিল্ডিং, ইনকাম ট্যাক্স বিল্ডিং, ক্যালকাটা কর্পোরেশন, ইন্সিওরেন্স অফিসগুলো। একএকটা জায়গায় পনেরো-বিশ বার করেও গিয়েছি। নিজের জবাবদিহি দেবার আকাঙক্ষা মানুষের এমনই প্রবল, এমনই রুচি তার যে সে মনে করে ইনকাম ট্যাক্স অফিসের একজন কেরানি হলেও জবাবদিহি দেওয়া হয়, কিন্তু দুটো কবিতার বই বের করলে হয় না। এই চার বছর যদি আমি এক মনে শিল্পসৃষ্টি করতাম, তা হলে অনেকগুলো মূল্যবান রচনা বের করতে পারতাম।" —যাক, চার বছর ঘুরেছ ভালোই করেছ; না-যদি ঘুরতে তা হলে হয়তো মনে করতে কতকগুলো আসার কবিতা লিখে রাজত্ব তো নষ্ট করলাম, রাজকন্যাও গেল।’ গোফে হাত বুলিয়ে বাবা বললেন—“আমাদের মন এই রকমই কেমন যেন রহস্যের জিনিশ।’ একটু চুপ থেকে—আজকাল দুপুরবেলা মেসে কী করো ? —'খবরের কাগজ পড়ি।’ —'খবরের কাগজ আর কতক্ষণ পড়া যায়?” —“বোর্ডাররা প্রায় চার-পাঁচখানা খবরের কাগজ রাখে। —‘পড়বার ভার দিয়ে যায় তোমার উপর ? —‘পড়তে মন্দ লাগে না কিন্তু শেষ পর্যন্ত—' —‘এই তো রচনার কথা বলছিলে, কিন্তু লেখোটেখো না কেন ? —“লিখতে চেষ্টা করি মাঝে-মাঝে।” وا\8