পাতা:জীবনের ঝরাপাতা.pdf/১০৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
॥ তের॥
(দ্বিতীয় পর্যায়)
শান্তিনিকেতন ও লেখকতার প্রারম্ভ

দিদি যখন কলকাতার বাইরে নিজের ঘর-সংসার করতে গেলেন আমি তখন মার কাছে একা রইলুম। তখন থেকে মার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হল। বিলেত যাওয়ার আগে পর্যন্ত দাদাও ছিলেন, কিন্তু দাদা ব্যাটাছেলে তাঁর বহির্মুখী জীবন। তাঁর সখ অনুসারে তাঁকে আরবী ঘোড়া কিনে দেওয়া হয়েছিল। ভোরে উঠে ঘোড়ায় চড়ে বেড়িয়ে আসা, বিকেলে হয় সরেনদের বাড়ি যাওয়া নয় নিজেদের বাড়িতে তাকে ও অন্যদের এনে খেলাধুলা, সন্ধ্যায় মাঝে মাঝে বাগানের গর্ত থেকে বেরন শেয়াল শিকার করা—এই সব তাঁর মুখ্য কাজ ছিল। পড়াশুনাটা গৌণ। সেই সময় ‘সখা’ নামে বালকবালিকাদের জন্যে মাসিক পত্রিকায় একটা কবিতা প্রতি-যোগিতা ঘোষিত হল। মা উৎসাহ দেওয়ায় আমি সেই প্রতিযোগিতার জন্যে দাঁড়ালুম। নির্দিষ্ট বিষয়ে কবিতা রচনা করে সখা-অফিসে পাঠিয়ে দিলুম। ফাস্ট আমিই হলুম, প্রাইজ পেলুম একখানা ইংরেজী ‘ক্লাসিকাল ডিক্‌শনারী', যত প্রাচীন গ্রীক ও রোমান মাইথলজির গল্প। প্রকাশ্যে রচনায় এই আমার হাতে খড়ি। লিখতে আরম্ভ করেছিলুম কিন্তু কয়েক বছর আগেই। আমাদের শৈশবে সেই সময় একবার সপরিবারে বোলপুর যাওয়া হয়। সেকালের শান্তিনিকেতন সত্যই শান্তিনিকেতন ছিল, ছেলে- বুড়ো সকলেরই মনোমোহন। কর্মকোলাহল ও জনকোলাহলশূন্য, শুধু, শান্ত মৌন প্রকৃতির অবাধ রাজত্বের বিস্তার।

 শান্তিনিকেতন বাড়িটির গাড়িবারান্দার কার্নিসের উপর অনেকগুলি বড় বড় সমুদ্র-শামুক সাজান ছিল। এমন শামুক এর আগে আমরা কখনও দেখিনি, কি রহসময় মনে হত। তার ছিদ্রের ভিতর কান পাতলে এমন একটা শব্দ পাওয়া যেত ঠিক যেন সমুদ্র কল্লোল। সমুদ্র নিজের তরঙ্গঘন চিত্ত যেন চিরদিনের মত তার ভিতর রুদ্ধ করে রেখেছে। 'সমুদ্র' নামটাই তখন আমাদের পক্ষে রহস্যময় ছিল। কর্তা দাদামশায়ের চীন ভ্রমণে যাত্রার বার্তার সঙ্গেই সে নামটি আমাদের পরিচিত হয়েছিল। হয়ত সেই সময়ই তাঁর সংগহীত এই শামুকগুলি। আর রহস্যময় ছিল বোলপুরের খোয়াই পাহাড় ও তাদের মধ্যে দিয়ে বালির ভিতর থেকে

৯১