পাতা:জীবনের ঝরাপাতা.pdf/১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

গাড়ির চলা থেমে গেল, আমার ভয় তখনকার মত নিরস্ত হল; কিন্তু সেটা চিরদিনের জন্য মাথার স্মৃতি-কোটরে দাগ কেটে রইল।

 বৈঠকখানা থেকে মা-রা সিমলার বাড়িতে উঠে যান। এখনকার মিনার্ভা থিয়েটারের পাশ দিয়ে একটা গলিতে সে বাড়ি। মনে পড়ে এই বাড়িতে থাকতে বছর চারেক বয়সে একদিন পা ফসকে ছাদের মার্বেল সিঁড়ি দিয়ে গড়াতে গড়াতে একেবারে নীচের তলায় পড়ে আমার সামনের দুটো দাঁত ভেঙে রক্তারক্তি হয়, হাতে-পায়েও চোট লাগে। কান্নাকাটি বেশি করতে সাহস পাইনি—আমার রক্ষিণী দাসীর ভয়ে। সে জোর গলায় প্রতিপন্ন করলে দোষ তার অমনোযোগের নয়, আমার অসাবধানতার। “আহা”, “উহুঁ” ত পেলুমই না কারো, উল্টে লাঞ্ছনার শেষ রইল না। দিদি খুব বিজ্ঞের মত শোনাতে লাগলেন চিরকাল ফোকলা হয়ে থাকব, লোকের সামনে বেরবার যোগ্য থাকব না। আমার ও দিদিদের দাসীবৃন্দ মিলিত হয়ে তার চেয়েও বড় রকম একটা সুনির্দিষ্ট বিভীষিকা খাড়া করলে—“বর এসে ফোকলা দাঁত দেখে ফিরে যাবে।” মা কোন সাড়াশব্দই করলেন না। বাবামশায় নীচে নেমে আর্নিকাদি লাগিয়ে দিলেন।

 বলেছি ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকেই মায়ের সঙ্গে আমাদের আর সাক্ষাৎ-সম্পর্ক থাকত না। তিনি আমাদের অগম্য রাণীর মত দূরে দূরে থাকতেন। দাসীর কোলই আমাদের মায়ের কোল হত। মায়ের আদর কি তা জানিনে, মা কখনো চুমু খাননি, গায়ে হাত বোলাননি। মাসিদের ধাতেও এসব ছিল না। শুনেছি কর্তা-দিদিমার কাছ থেকেই তাঁরা এই ঔদাসীন্য উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলেন। বড়মানুষের মেয়েদের এই ছিল বনেদী পেট্রিশিয়ন চাল। গরীবের ঘর থেকে আসা ভাজেরা কিন্তু তাদের প্লিবিয়ানের হৃদয় সঙ্গে করে আনতেন—ছেলেমেয়ের সঙ্গে তাঁদের ব্যবহার আর এক রকমের দেখতুম। সে কথা পরে বলব।

 পড়ে গিয়ে দাঁতভাঙার ব্যাপারে মা আতুপুতু না করায় কোন অভাব অনুভব করলাম না, কারণ সেটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত। কিন্তু আর এক দিনের বড় রকম এক ব্যাপারে মনের ভিতর দিয়ে বিচারের একটা খটকা বাজল বুকে। শিশুরা শুধু হাসে-কাঁদে না, তাদের মাথায় বিচার-অবিচার বোধের খেলাও অন্তঃসলিলভাবে অনেক সকাল সকালই চলতে আরম্ভ করে।

 আমাদের সব ছোট বোন ঊর্মিলা তখনও জন্মায়নি। দিদি হিরন্ময়ী, দাদা জ্যোৎস্নানাথ ও আমি—এই তিনজনে আছি তখন। দিদি আমাদের