পাতা:জীবনের ঝরাপাতা.pdf/১৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

কদমা-কাসুন্দী-কুলকুটো ও বিশেষ চাষের খাজা কাঁঠালের সহাগমন সূচনা করত, শীতকাল হলে খেজুর গুড়ের পাটালী ও কলসী কলসী গুড়। তাঁর আগমন তৈলসিক্ত দেহে জলচৌকিতে বসে ঘরের বাইরে খোলা হাওয়ায় স্নানের দৃশ্য খুলে দিত। তাঁর আগমন বাড়ি ছেড়ে ডাকাতদের সম্মুখীন হয়ে যুদ্ধ-কাহিনীতে কর্ণকুহর ভরিয়ে দিত। তাঁর আগমন পুলিসের পেয়াদাকে ফাঁকি দিয়ে খাল-বিল থেকে খাল-বিলান্তরে নৌকাযোগে বিচরণ করে তাঁর জমিদারীতে খুনের মকদ্দমায় কাছারীতে হাজির হওয়ার সমন এড়ানর বিপুল বিস্ময়কর কথায় শরীরকে রোমাঞ্চিত করত। কিন্তু যেখানে সবচেয়ে বেশি তিনি আমাকে স্পর্শ করতেন, সেটি হচ্ছে আমার মর্মকোণের একটি শুষ্ক নিভৃতে। তাঁর স্নেহবিগলিত “দিদি, দিদি” সম্ভাষণটি সেইখানে ছুয়ে মধু-প্লাবন করত। বাড়ির মরু হাওয়ায় যেন একটি অদ্ভুত ওয়েসিসের সমাচার আনত। এখন চিরে চিরে বিশ্লেষণ করে বর্ণনা করছি। তখন কোনই বিশ্লেষণীশক্তি ছিল না—শুধু একটি স্নিগ্ধতার সরস অনুভূতি মাত্র ছিল।

 আর একজন আত্মীয় আসতেন ঐ বাড়িতে—তিনি আমাদের পিসেমশায়—পরেশনাথ মুখোপাধ্যায়, ত্রিপুরা স্টেটের ডাক্তার। তাঁর সঙ্গে মধ্যে মধ্যে তাঁর ভ্রাতুষ্পত্র ফণিভূষণ মুখোপাধ্যায় আসতেন। এঁরই সঙ্গে দিদি হিরন্ময়ীর পরে বিবাহ হয়।

 একবার পিসেমশায় আসার পর, আমি পাঁচ বছরে পড়তে আমার হাতেখড়ি হল। বাড়িতেই একজন পণ্ডিত থাকতেন, পিসেমশায়দের দেশেরই লোক, সতীশ মুখুয্যে। তাঁর কাছে একদিনেই আমার বর্ণপরিচয়ের প্রথমভাগ শেষ হয়ে গেল। পিসেমশায়ের হুঁকোর খোলের ভিতর পয়সা ও দু-আনা চার-আনার রেজকি ভরা থাকত। তার থেকে আমাদের প্রায়ই কিছু না কিছু বিতরণ করতেন। তাঁর এক-একগাছি পাকা চুল তুলে দিয়ে দিদি-দাদা দু-চার আনা পুরস্কার প্রায়ই অর্জন করতেন। আমার সে বিষয়ে পটতা ছিল না, তাই সে রকম কিছু রোজগার হত না। কিন্তু সকাল থেকে বিকেলের মধ্যে প্রথমভাগখানা আদ্যোপান্ত শেষ করার খবরটা রটায় সেদিন পিসেমশায়ের হুঁকোর খোল খালি হয়ে আমার হাত বেশ খানিকটা ভরল। অর্থাৎ আমার দাসীর ভাগ্যি সেদিন খুলে গেল—এতদিন দিদি-দাদার দাসীরাই ভাগ্যিমন্ত হত। কেননা, আমাদের রোজগার আমাদের কোন কাজে লাগত না, তাদের দ্বারা বাজেয়াপ্ত হয়ে তাদেরই ভোগে আসত।