পাতা:জীবনের ঝরাপাতা.pdf/১৮১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ব্যতিরেকে তাঁকে প্রণিপাত করা যায় না, তাঁর হস্তকল্পনা ব্যতিরেকে তাঁর হাতে হাত রেখে চলা যায় না, তাঁর আঁখি কল্পনা ব্যতিরেকে দিবীব চক্ষুরাততং—আমাদের প্রতি তাঁর স্নেহমাখা নির্নিমেষ আঁখি দেখা যায় না—সে আঁখিতে আঁখি রাখা যায় না। কল্পনাতে তাঁকে ইন্দ্রিয়ময় রূপময় দেবমূর্তিতে দেখতে হয়, সাকার করতেই হয়। তা দোষের নয়, কেননা, খ্রীস্টানরাও তাই করেন। কিন্তু ছবিতে, মৃত্তিকায় বা প্রস্তরে আমার কাল্পনিক ভাবমূর্তিকে আকারযুক্ত করলেই Heathenism হল। নবযুগের খ্রীস্টান মিশনারির অঙ্কুশাঘাতে বিদ্ধ ভারতবর্ষ এই Heathenism-এর অপবাদ সহ্য করতে পারলে না। অথচ দেশের যুবকদের খ্রীস্টান হয়ে যাওয়াও সহ্য করতে পারলে না—তাতেও জাতীয় আত্মাভিমানে ঘা লাগে। তাই নিরাকার ব্রহ্মোপাসনার ঘোষণা হতে থাকল, তারই প্রচার ও প্রতিষ্ঠা চলল—দেশ থেকে প্রতিমা পূজা তুলে দেবার প্রচেষ্টা হল—না হলে যেন ‘অসভ্য’ ‘বর্বর’ আখ্যার যোগ্য হব আমরা। এই হল রামমোহনের বা ব্রাহ্মধর্মের যুগ। কিন্তু শীঘ্রই নবতর যুগ দেখা দিল—এবার নিরাকারের সঙ্গে সঙ্গে সাকারের যুক্তিপূর্ণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা হল, কেননা এ যুক্তির যুগ। শুধু উপনিষদ নয়, হিন্দুর সকল ধর্মপুস্তক—সকল ‘scriptures’-গুলিই আবার সকলে ভাঁজতে লাগল, সেগুলি ঘেঁটে ঘেঁটে উল্টেপাল্টে দেখতে লাগল। দেখলে অমূল্য রত্নরাজিতে ভরা, বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়ে দেওয়ার মত একেবারে নয়। অনেক ব্রাহ্মসমাজীরাও আবার ‘হিন্দু’ বলে নিজেদের পুনরাখ্যাত করলেন, সাধনার সহায়স্বরূপ গৃহে প্রতিমার পুনঃস্থাপনা করলেন। বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী যিনি ব্রাহ্মসমাজের একজন নেতা ছিলেন—দলভঙ্গ করে বেরিয়ে এলেন, দলে দলে ব্রাহ্মরাই তাঁর শিষ্য হলেন। তারপরে এলেন এক ‘dynamic personality’—স্বামী বিবেকানন্দ। ‘Dynamic’ সেই—যার ভিতর বারুদের ধর্ম আছে, প্রচণ্ড তেজ, প্রচণ্ড ভাঙ্গাগড়ার শক্তি। সেই বারুদের আগুন থেকে একটা স্ফুলিঙ্গ আমার ভিতর এসে পড়েছিল—আমায় ভেঙ্গে গড়ে তুলছিল। আমার আধ্যাত্মিক পিপাসা আমায় শৈশবের গতানুগতিক ‘ব্রাহ্মধর্ম’ থেকে অনেক দূরের পথে নিয়ে চলছিল।

১৬৬