পাতা:জীবনের ঝরাপাতা.pdf/১৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
॥ দুই॥

সিমলে বাড়িতে বাড়ির ভিতরের দিকের সিঁড়ি উঠেই মায়ের শোবার ঘর। ঘরে এক প্রকাণ্ড পালঙ্ক। সেই পালঙ্কের উপর যোড়াসাঁকো থেকে সমাগত মাসি, মামী ও দিদিদের প্রায় নিত্যই মধ্যাহ্ন থেকে গড়ান পার্টি জমত। তাসখেলার অবসরে কাঁচা সরষে তেল মাখা টাটকা মুড়ি, ফুলুরি ও বেগুনির রসাস্বাদন, বর্ষা হলে সাঁৎলাভাজি—এই ছিল পার্টির মূল প্রোগ্রাম। প্রোগ্রামে কোন কোন দিন একটু বৈচিত্র্য ঢোকান হত গানে বা মায়ের রচিত কবিতা আবৃত্তিতে। আমরা তিনটি ভাইবোন ঘুরে-ফিরে সেখানে ফস করে এক-একবার হাজির হতুম যদি একমুঠো মুড়ি বা এক-আধটা ফুলুরি ভুলে আমাদের মুখে কেউ পুরে দেয়। কিন্তু আমরা তাঁদের গ্রাহ্যর মধ্যেই বড় একটা আসতুম না, বেশিক্ষণ দাঁড়াবার হকুমও ছিল না, চকিতেই সরে পড়তে হত। বড়দের মজলিসে ছোটদের দখল দেওয়া নিয়মবহির্ভূত ছিল।

 এই পালঙ্ক সম্মিলনী দেখে আমার মনে মনে একটা ধারণা বসে গিয়েছিল পালঙ্কই হল প্রত্যেক মায়ের স্বাভাবিক বসবার জায়গা, মায়েরা কখনো মাটিতে বসে না। আমাদের দাসীরা যখন তাদের দেশে তাদের মায়ের কথা বলত, আমি কল্পনার চক্ষে দেখতুম, মেমারি গ্রামে বা বঁইচিতে বা গুপ্তিপাড়ায় তাদের মায়েরাও এই রকম বৃহৎ পালঙ্কে পা ছড়িয়ে বসে আছে। মা বলতে আমারও যেমন মা, ওদেরও তেমনি মা। রুপকথার রাজকন্যা বা তাদের রাজরাণী মায়ের ত কথাই নেই।

 গরীব দুঃখী সব মাকেই পালঙ্কে জোর করে বসানর উদ্ভ্রন্ত কল্পনা ছেড়ে দিলেও আমাদের দেশের গহিণীদের জীবনযাত্রায় পালঙ্ক যে সামাজিক অন্তরঙ্গতা সাধক একটা মস্ত গহসজ্জা সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। বাড়িতে মেয়েদের মজলিস ভাল করে জমকায়ই না সবাই মিলে এক খাটে না বসলে। শুধু বাঙলা দেশে নয়, পশ্চিমে ও উত্তর-পশ্চিমে ভারতের সর্বত্রই এই। কোথাও বলি পালং, কোথাও খাট, কোথাও খাটিয়া, কোথাও গদি সতরঞ্চিপাতা বৃহৎ তক্তপোষ, কোথাও ঢালা ফরাস বিছানা—জিনিস একই। ছাড়া ছাড়া আলাদা চেয়ারে বসে প্রাচ্যের তৃপ্তি হয় না, একসঙ্গে, কাছাকাছি একটা আসনে বসলে তবে মন ভরে।

 সিমলে বাড়ির পর্ব এইখানে শেষ হল। এখানে থাকতেই