পাতা:জীবনের ঝরাপাতা.pdf/২০৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

কর্ত্রীরা এই সমাধিতে এসে শহীদের স্মরণে প্রণিপাত করে পুষ্পাঞ্জলি ও কড়াপ্রসাদ (মোহন ভোগ) নিবেদন করেন। এটি একটি অবশ্যকর্তব্য কর্ম, সব শেষে এইটি না হলে কোন সামাজিক কাজ সম্পূর্ণ হয় না। আমার স্বামী সসঙ্কোচে আমায় জিজ্ঞেস করলেন,—‘‘আমাদের কুলের এই রীতি তুমি অনুসরণ করবে কি? নববিবাহিত বধূর সেখানে গিয়ে প্রণিপাত করার নিয়ম মানবে কি? এটা কুসংস্কার ভেবে যদি বর্জন করতে চাও আমি আপত্তি করব না।” আমি বললুম—“নিশ্চয়ই মানব। কুসংস্কার কিসের? এ ত গৌরবের কথা যে এমন ঘরে পড়েছি যাঁদের বংশে এতবড় বীরপুরুষ জন্মেছিলেন যিনি ‘শহীদ’ বলে আজও গণ্য ও পূজ্য, যাঁর স্মৃতি আজও উত্তরপুরুষদের গর্ব ও উৎসাহের কারণ।” আমার কঞ্জরূরে আদি শ্বশুরালয়ে যাওয়ার দিন ধার্য হল। লাহোর থেকে অমৃতসহরে গিয়ে সেখানে গুরুদাসপুরের ট্রেন ধরতে হয়। মধ্যপথে বাটালা শহর আসে। সেই পর্যন্ত রেলে যাত্রা। সেখানে নেমে টঙ্গা বা এক্কাযোগে ডেরা বাবানথনকে পৌঁছে রাবী নদী পার হতে হবে। নদীর উপর খুব চওড়া নৌকায় মানুষ, গরু, ঘোড়া সব পার হচ্ছে। অল্পক্ষণেই ওপারে পৌঁছন গেল। এখানে আর সকলের জন্যে ঘোড়া অপেক্ষা করছে, আমার জন্যে ডুলি—এদেশে পাল্কী পাওয়া যায় না। ডুলি চড়ে রীতিমত কনে বউয়ের মত আট-দশ মাইল গিয়ে আবার একটি ছোট্ট স্বল্পতোয়া নদীর ধারে পৌঁছলুম, নদীর নাম বসন্তর—তার ওপারেই কঞ্জরূর। বেহারারা ডুলিসমেত হেঁটে নদী পার হল, অশ্বারোহীরাও নদীর উপর দিয়ে ঘোড়া হাঁটিয়ে নিয়ে গেলেন। ওপারে গ্রাম্য লোকেরা ও অনেক আত্মীয়-আত্মীয়ারা সমবেত হয়েছেন। বেহারাদের কাঁধ থেকে ডুলি নামিয়ে তাঁদের যা যা মঙ্গলাচার করবার, তা করলেন। এদেশে শাঁখ বাজান বা উলু দেওয়া নেই; কিন্তু দীপ হাতে নিয়ে বরণ করা আছে। বাড়ি পৌঁছে আহারান্তে বিশ্রাম করলুম। বিশ্রামস্থল নিভৃত নয়, আত্মীয়স্বজন পূর্ণ। বিকেল হতে না হতে উঠে বসতে হল। আশপাশের পাঁচটি গ্রাম থেকে লোকস্রোত বয়ে আসছে—কলকাতা হতে আসা বি-এ পাশ-করা চৌধুরী সাহেবের নতুন বউকে দেখতে। সবাই আশ্চর্য যে এতটা লেখাপড়া জানা মেয়ে শ্বশুরদের ক্ষুদ্র গ্রামে আসতে রাজী হল—আর সে নাকি ‘বাবা ঠক্করের মহলে’ গিয়ে মাথা টেকবে—অর্থাৎ প্রণত হবে।

 এ বিষয়টা নিয়ে লাহোরেও পরে খুব চর্চা হয়েছিল। পঞ্জাব ব্রাহ্মসমাজের মেয়েদেরও তাদের সনাতনী আত্মীয়স্বজনেরা আমার দৃষ্টান্তের

১৯২