পাতা:জীবনের ঝরাপাতা.pdf/২৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

কত মানাভিমানের তরঙ্গ এই ঘরগ‌ুলির দেওয়ালে আবদ্ধ আছে। দেওয়াল ফেটে তারা কোনদিন কেদে বেরতে চায় না কি? কথা কইতে চায় না কি?

 মায়ের সঙ্গে আমাদের কোন সাক্ষাৎ সংযোগ ছিল না। কিন্ত‌ু বিকেলে বাড়ির অন্য ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বাইরের তেতালার ছাদে খেলা করতে যাওয়া আমাদের নিত্যকৃত্য ছিল—সেই সময় দুর থেকে মা আমাদের চোখে ভাসতেন—অগম্য দেবী-প্রতিমার মত।

 তিনি যে আমাদের আপনার মত করে ব্যবহার করতেন না, কাছে ডাকতেন না, আদর করতেন না, তার দরুন কিন্ত‌ু আমরা তখন মোটেই অসুখী ছিলুম না। সিমলের অল্পপরিসরের স্বতন্ত্র বাড়িতে যেখানে পিতামাতার সঙ্গে স্থানগত দূরত্বটা সামান্যই ছিল সেখানে বরঞ্চ অসুখী হবার বেশী সম্ভাবনা ছিল। কিন্ত‌ু যোড়াসাঁকোতে দিকদেশের অতিবেশী ব্যবধান মায়ের সঙ্গে সন্তানের মানসিক ব্যবধানটা ঢেকে দিত। ঈশ্বর ও জীবের লীলার মধ্যে প্রকৃতির একটা মধ্যবর্তিতা যেমন থাকে, মানুষ হাসে কাঁদে উঠে বসে ঈশ্বরের নির্দেশে যন্ত্রচালিত পুতুলের মত কিন্ত‌ু যন্ত্রপরিচালনার আসল কাজটি সমর্পিত থাকে মানুষের নিজের অন্তঃপ্রকৃতি বা ভগবানের পাটরাণী জাগতিক বহিঃপ্রকৃতির উপর; তেমনি আমাদের পিতামাতার ইচ্ছার দ্বারা আমাদের মূল জীবনপদ্ধতি নিয়ন্ত্রিত ছিল বটে, কিন্ত‌ু তার আসল খেলানটা চলেছিল যোড়াসাঁকোর বাড়ির প্রাকৃতিক অবস্থা, স্থানগত বিরাটত্ব, মাস্টার পণ্ডিত, দাসদাসী ও সে বাড়ির অন্যান্য ছেলেমেয়েদের সংসর্গ। এদের সঙ্গে চলাফেরা, মেলামেশা, খেলাধুলা আড়ি ও ভাবের দোলার দোলনে আমরা মা-বাবার সম্পর্কশূন্যতার বোধে ক্লিষ্ট হতাম না। মায়ের আদরে অভিমানে তুলতুলে হইনি, নিজের প্রতি অনুকম্পায় কাতর-হৃদয় হইনি, নিজেটাকে ভুলেই শক্ত-সমর্থমনা হয়ে মানুষ হয়েছি।

 যোড়াসাঁকোর অন্যান্য ছেলেমেয়েদের থেকে আমাদের জীবনযাত্রায় দুটি বড় রকমের পার্থক্য ছিল। তাঁদেরও ঝি-চাকরেরা তাঁদের পরিচর্যা করত, কিন্ত‌ু আমরা একেবারে তাদেরই হাতে সমর্পিত ছিলুম। স্থানগত অতিব্যবধানবশত ইচ্ছা হলেও মায়ের পক্ষে সম্ভব ছিল না আমাদের দেখাশ‌ুনা করার। তাঁর মহল প্রায় আর এক পাড়ায় ছিল। তাই আমাদের তিন ভাইবোনদের প্রত্যেকরই এক একটি স্বতন্ত্র পরিচারিকা ছিল। তারা স্ব স্ব বুদ্ধির অনুসারে নিজের কর্তব্য ভালভাবেই পালন করত। যে যার

১৩