পাতা:জীবনের ঝরাপাতা.pdf/২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

এবং শেষে তাঁর কনিষ্ঠ ছেলে কৃতী। ওদের মাস্টারমশায় ছিলেন “স্যর্”—মেট্রপলিটনের হেডমাস্টার ব্রজবাবু। অতি সরস, অতি সহাস্য, অতি মজাড়ে লোক। তাঁর কোনোই শাসন ছিল না, বরঞ্চ অহেতুক পুরস্কার ছিল। তাঁর শাসনপ্রবৃত্তি মেট্রপলিটনের ছাত্রদের উপর দিয়েই নিঃশেষিত হত। তাদের কাছ থেকে শাস্তিস্বরুপ বাজেয়াপ্ত করা ছুরি, রঙীন পেন‌্সিল প্রভৃতি কিছু না কিছু পকেট থেকে ফস করে বাড়ির পড়ুয়াদের দেখিয়ে ও দিয়ে তিনি তাদের আনন্দে আনন্দ পেতেন। মাঝে মাঝে আমাদের পড়ার ঘরে এসে এই মাস্টারমশাই আমাদের পণ্ডিতমশায়ের সঙ্গে ভদ্রতার বিনিময় করতেন, তখন আমরাও পড়াশ‌ুনা থেকে খানিকক্ষণের জন্যে ছুটি পেতুম, আর পেন‌্সিল বা পকেট-ছুরির ভাগও পেতুম। একদিন পণ্ডিতমশায় আমাকে ও দাদাকে কোণে দাঁড়ানর বদলে শাস্তি দিলেন পড়ার টেবিলের তলায় গিয়ে গ‌ুটিসুটি মেরে বসতে। আর হ‌ুকুম করলেন—“আজ ব্রজবাবু যখন আসবেন, আমার সঙ্গে গল্পসল্প করবেন, তখন তোমরা ঐখান থেকে তার পায়ে চিমটি কাটবে, তাঁর খুব আমোদ হবে।” একে শাস্তি পাওয়ার লজ্জা তার উপর সেটা নিজে জাহির করা বেহায়াপনার দ্বারা—এই শাস্তির উপর শাস্তি; এই রকম নির্লজ্জ ব্যবহারশীল হতে হওয়া—এইটে ভয়ানক বাজল। পণ্ডিতমশায় মধ্যে মধ্যে আমাদের শ‌ুনিয়ে শ‌ুনিয়ে গল্প করতেন সেকালের পাঠশালায় গ‌ুর‌ুমশায়দের উর্বর মাথায় কত রকমের রোমাঞ্চকর শাস্তির উদ্ভাবনা হত। সে সবের তুলনায় আমরা যে সব শাস্তি পাচ্ছি, এ ত কিছুই নয়। তাঁর র‌ুলের স্পর্শ তো ফুলের স্পর্শ।

 এ-বাড়ির আর এক ঘরেও ছেলেমেয়েরা কড়া শাসনে পালিত হয়েছেন, সে কিন্ত‌ু তাঁদের স্বয়ং বাপমায়ের—ঝি মাস্টারের নয়। সেজমামা হেমেন্দ্রনাথের কন্যা প্রতিভাদিদি ও তাঁর ভাইবোনেরা পড়াশ‌ুনা ও সঙ্গীত অভ্যাসের নিয়মনিগড়ে একেবারে বদ্ধ থাকতেন। নিয়ম থেকে একটু বিচ্যুত হলে সেজমামার হাতে উত্তম-মধ্যম পেতেন। বাড়ির অন্যান্য ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মেলামেশার তাঁদের সময় হত না, জীবনের প্রথম দিকটায় প্রবৃত্তিও ছিল না। তাঁদের মহলের কবাট কি ভিতরের, কি বাইরের—অর্গলবদ্ধই থাকত, অবাধ গতিবিধি ছিল না কারো। যত বড় হতে লাগলেন এক-একজনের কবাট খুলতে লাগল, কিন্ত‌ু শেষ পর্যন্ত দুই-একজন কুনো রইলেন। আশ‌ুতোষ চৌধুরীর সঙ্গে প্রতিভাদিদির বিবাহের সূত্রে তাঁদের মহলের মনের ঘর সব প্রথম খুলল।

১৫