পাতা:জীবনের ঝরাপাতা.pdf/৩০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

হাত ঘড়িতে নাগাল পাবে না তা অনুমান করলেন। সুপ্রভাদিদিকে খানিক আগে এ অঞ্চলে উসখুস করতে দেখেছেন, বুঝে নিলেন এ তাঁরই কীর্তি। তবু দিদির মেয়েকে বকাঝকার অধিকার তাঁর নেই, আর প্রকৃত দোষী ত আমি—তাঁর নিজের মেয়েই; সুতরাং শাস্তি আমারই প্রাপ্য। তাই আমাকে একটি চড় মেয়ে শাস্তি দিতে কৃতসংকল্প হলেন। কিন্তু ঘরে তখন অন্য লোকেরাও এসেছেন। কারো সামনে চড় তোলাটা অশোভনতা বলে মা তাঁদের সরে যেতে অনুরোধ করে একটি কোমল চপেটাঘাত আমার গালে স্পর্শ করালেন।

 মঙ্গলা দাসীর বিরাশী সিক্কার ওজনের চড় ও মায়ের এই চড়ে কত তফাৎ! লোকের সামনে রাগ করায়, ছেলেপিলেকে মারায় আত্মমর্যাদার হানি হয়-এই যে সৌকুমার্য মা সেদিন প্রকটিত করলেন, পরজীবনে তাঁর অনেকানেক সুকুমার ব্যবহারের তা অগ্রপরিচয়।

 পরোপকারী সুপ্রভাদিদির চেষ্টা কিন্তু নিষ্ফল হল না। সেদিন থেকে আমার প্র্যাকটিসের সময় এক ঘণ্টা হতে আধ ঘণ্টায় নেমে গেল।

 বলেছি, উত্তরোত্তর আমাদের উপর লেখাপড়ার চাপ বেশি করে পড়তে লাগল। স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর সন্ধাবেলায় গানবাজনার মাস্টার ভীমবাবু চলে গেলেই খাস হোম-টিউটরের কাছে ইস্কুলের পড়া তৈরি আরম্ভ হত। রাত ৯টা পর্যন্ত তিনজনকে পালা করে পড়ান চলত। দেউড়িতে ঢং ঢং করে ৯টার ঘণ্টা বাজলে আমাদের ছুটি দেওয়া হত। ঘুমে চোখ ঢুলঢুল করে বাড়ির ভিতরে নিজেদের ঘরে দাসীদের কাছে খেতে-শুতে আসতুম।

 সেই সময় সেজমামার বাইরের ঘরটার পাশ দিয়ে আসতে গা ছম্‌ছম্ করত। তিনি নাকি যখন একবার ডাক্তারি পড়তেন, সেই ঘরটায় মড়া কাটতেন, তাই ঘরে ভূত ভরা। সুপ্রভাদিদি সব-জানতা, সব ভয়ের প্রতিকারও তাঁর জানা বিদ্যের মধ্যে। তিনি আমাদের গুরু হয়ে শেখালেন ‘রাম’ ‘রাম’ বল্লে ভুতের ভয় কেটে যায়, আর একটু লোহা গায়ে রাখলেও ভূত একেবারে পালায়। দিদি তখন খোঁপা বাঁধতে আরম্ভ করেছেন, মাথায় লোহার কাঁটা থাকে, সুতরাং তাঁর নিজের গায়েই অস্ত্র রয়েছে। আমি নিরস্ত্র, টুপ্ করে পার হয়ে বাড়ির ভিতরের মোহনায় খড়খড়িঘরে ঢুকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচতুম। দাদা নির্ভীক, ভূতের ভয় ছিল না তাঁর।

 নিজেদের ঘরে এসে খেয়েই যে তৎক্ষণাৎ ঘুমুতে যেতুম সব সময় তা নয়। সেজমাসিমাদের ‘দশ-পঁচিশ’ ও ‘তাসে’র আড্ডা জমত ঐ সময়।

১৯