পাতা:জীবনের ঝরাপাতা.pdf/৩৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

হয়ত দাদা-দিদিরা জানেন, কিন্তু আমি তখনও জানতুম না মা-ই Supreme Court, মায়ের অনুমতির বিরুদ্ধে পণ্ডিতমশায়ের হুকুমের উপর মায়ের কাছে আপীল আছে। এমনি অকরুণ হর্তাকর্তাবিধাতার হাতে পড়েও যে কতটা আনন্দের অবসর ছিল আমাদের শৈশব জীবনে তাই আশ্চর্য হই। শিশুচিত্তের স্থিতিস্থাপকতা তার একটা প্রধান কারণ।

 যদিও সুরেন বিবি দুই ভাই-বোনে ইংরেজী স্কুলে ভর্তি হলেন—একজন সেণ্ট জেভিয়ার স্কুলে আর একজন লরেটো কনভেণ্টে, আর আমার দাদা জ্যোৎস্নানাথ ও আমি দেশী স্কুলের ছাত্রছাত্রী রইলুম, তবু আমাদের দুটি জোড়া ভাইবোনে খুব ভাব হল। বাড়ির মধ্যে আমাদেরই বেশী মিল—শিক্ষাদীক্ষা এক ধরনের, কিন্তু গোড়ায় গোড়ায় আমাদের রুচি ও আদর্শের অনেক পার্থক্যও ছিল। বেথুন স্কুলের আবহাওয়ায় আমি ছিলাম ভারি স্বদেশপ্রেমিক। নতুন মামা একদিন আমাদের কোন একটা সার্কাসে নিয়ে যেতে চাইলেন—একটা বাঙালীর ও একটা উইলসন সাহেবের—যেটায় আমাদের অভিরুচি। আমি বললুম—“বাঙালীর সার্কাসে যাব।” টাট‌্কা বিলেত প্রত্যাগত মেজমামীর ছেলেমেয়েরা বললেন, সাহেবের সার্কাসে যাবেন, কেননা বাঙালীর সার্কাস নোংরা। আমি বললুম—“হলই বা একটু নোংরা। কত কষ্ট করে বাঙালীরা নিজেদের একটা কিছু গড়ে তুলছে—তাদের দেখব না?” নতুন মামাও স্বদেশী। তাই সেবারটা বাঙালী সার্কাসেই যাওয়া হল। বড় হয়ে মেজমামীর ছেলেমেয়েরাও ক্রমে ক্রমে বিচারে আচারে স্বদেশী হতে থাকলেন। “হিন্দুস্থান কো অপারেটিভ ইন্স্যুরেন্স” সুরেনের একটি মস্ত স্বদেশী কীর্তিস্তম্ভ।

 এদিকে স্কুলে উপর ক্লাসের কতকগুলি মেয়েদের নেতৃত্ব-প্রভাবে আমার জাতীয়তার ভাব উত্তরোত্তর বর্ধিত হতে লাগল। তাঁদের মধ্যে অন্যতম নেত্রী ছিলেন—কামিনী দিদি ও অবলা দিদি—কবি কামিনী রায় ও লেডি অবলা বসু। তাঁদের নির্দেশগুলি আমাদের কাছে প্রবহমান হয়ে আসত আমার দিদি ও তাঁর সহপাঠিনীদের মধ্য দিয়ে। সব সময় সব ব্যাপারগুলি না বুঝেও তাঁদের আদেশানুযায়ী কাজ করতুম। ইলবার্ট বিলের আন্দোলনে সুরেন বাঁড়ুয্যে যখন জেলে যান, তখন সবাই একটা কালরঙের ফিতে আস্তিনে বাঁধলুম। কেন তা ঠিক জানতুম না। কিন্তু রাস্তায় স্কুলযাত্রী অনেক ছেলেদের হাতেও সেই রকম ফিতে দেখে একটা সহবেদনার বৈদ্যুতী খেলতে লাগল মনে। একটা বড় কিছুর সঙ্গে

২৮