পাতা:জীবনের ঝরাপাতা.pdf/৭১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বিলেত পাঠান হল, আর কয়েক বছর পরে তিনি সেখান থেকে সিভিল সাভির্স পাস হয়ে এলেন।

 দিদির বিয়ের পূর্বে কাশিয়াবাগানে পাড়ার মেয়েদের জন্য আমরা দুজনে মিলে একটা পাঠশালা খুলেছিলুম। দিদি হলেন প্রধানা শিক্ষয়িত্রী, আমি হলুম তাঁর এসিস্ট্যাণ্ট। তখন তাঁর বয়স চৌদ্দ-পনের, আমার বয়স দশ-এগার। আমরা নিজেরা তখন দিনের বেলা বেথুন স্কুলে যাই, সকালে-সন্ধ্যায় বাড়িতে সতীশ পণ্ডিতের কাছে স্কুলের পড়া তৈরি করি, সংস্কৃতের পণ্ডিতের কাছে সংস্কৃত, ওস্তাদ ও মেমের কাছে গান, সেতার ও পিয়ানো শিখি, আর ইস্কুল থেকে ফিরেই তাড়াতাড়ি মুখ-হাত ধুয়ে কিছু খেয়ে নিয়ে সাড়ে চারটে থেকে সাড়ে ছটা পর্যন্ত দুই ঘণ্টা রীতিমত ইস্কুল চালাই। বাঙলা, ইংরেজি, অঙ্ক ও সেলাই—এই চারটি বিষয়ই শেখাতুম আমরা নিজে। প্রায় কুড়িটি মেয়ে আসত, কেউ কুমারী, কেউ বা বাল-বিধবা। চাঁদনির সিঁড়ির উপর ধাপে ধাপে বসান হত তাদের ঠিক যেন কোন বড় ইস্কুলের গ্যালারীতে বসেছে। তারা যখন খিড়কির দুয়োর দিয়ে পুকুরে জল তোলার জন্য নিত্য আনাগোনা করত, তখনি তাদের দেখে আমাদের মনে তাদের জড় করে পড়ানর কল্পনা উদয় হয়। সন্ধ্যের পূর্বে যোড়াসাঁকোর আত্মীয়দের প্রতিদিনই সমাগম হত। আমরা তাঁদের কারো কারো দ্বারা মেয়েদের পরীক্ষা গ্রহণ করাতুম—একবার রবি-মামার হাত দিয়ে প্রাইজ দেওয়ার সমারম্ভেরও ত্রুটি হয়নি। দিদির বিয়ের পর আমি কিছুকাল একলা সে স্কুল চালালুম। যখন আমার এণ্ট্রান্স পরীক্ষার দিন ঘনিয়ে এল, তখন সে স্কুল বন্ধ করতে হল।

 উপর্যুপরি অনেকগুলি সন্তানবিয়োগ হয় দিদির। তাঁর হৃদয় স্নেহদানের জন্য বুভুক্ষিত ছিল। তিনি সখি-সমিতির আশ্রিত কোন কোন অনাথ বালিকাদের নিজের কাছে রেখে পালনের জন্য উন্মুখ হলেন। তারাই তাঁকে “মা” বলে। ঠিক নিজের মেয়ের মতো তাদের জন্যে সব করেন তিনি। এই সময় বরানগরে শশিপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিষ্ঠিত বিধবাশ্রমের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। মায়ের প্রতিষ্ঠিত সখি-সমিতি যখন কাল-প্রভাবে ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ল, তখন তাকে সঞ্জীবিত রাখার চেষ্টায় দিদি তাকে নাম ও আকারের নানা পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে চালিয়ে বর্তমান বিধবা শিল্পাশ্রমে পরিণত করলেন। এই শিল্পাশ্রমটি তাঁর একান্ত উদ্যম, বিপুল অধ্যবসায় অনেক দ্বন্দ্ব ও অনেক প্রীতি দিয়ে গড়া।

৬০