থেকে থেকে হঠাৎ একটি দুটি নৌকো সেই ঘন কুয়াশার ভিতর থেকে স্বপ্নের মত বেরিয়ে আসত।
দেখেছি, গঙ্গার অনেক রূপই দেখেছি। তাই তো বলি, আজকাল ভারতীয় শিল্পী বলে নিজেকে যারা পরিচয় দেয় ভারতীয় তারা কোন্খানটায়? ভারতের আসল রূপটি তারা ধরল কই? তাদের শিল্পে ভারত স্থান পায়নি মোটেই। কারণ তারা ভারতকে দেখতে শেখেনি, দেখেনি। এ আমি অতি জোরের সঙ্গেই বলছি। আমি দেখেছি, নানারূপে মা গঙ্গাকে দেখেছি। তাই তো ব্যথা বাজে, যখন দেখি কি জিনিস এরা হারায়। কত ভালো লাগত, কত আনন্দ পেয়েছি গঙ্গার বুকে। একদিনও বাদ দিইনি, আরো দেখবার, ভালো করে দেখবার এত প্রবল ইচ্ছে থাকত প্রাণে। গঙ্গার উপরে সে বয়সে কত হৈচৈই না করতুম। সঙ্গী সাথিও জুটে গেল। গাইয়ে বাজিয়েও ছিল তাতে। ভাবলুম, এ তে মন্দ নয়। গানবাজনা করতে করতে আমাদের গঙ্গা-ভ্রমণ জমবে ভালো। যেই না ভাবা, পরদিন বাঁয়া তবলা হারমোনিয়ম নিয়ে তৈরি হয়ে উঠলুম স্টীমারে। বেশির ভাগ স্টীমারে যারা বেড়াতে যেত তারা ছিল রুগীর দল। ডাক্তারের প্রেসকিপশন গঙ্গার হাওয়া খেতে হবে, কোনোরকমে এসে বসে থাকেন— স্টীমার ঘণ্টা কয়েক চলে ফিরে ঘুরে এসে লাগে ঘাটে, গঙ্গার হাওয়া খেয়ে তারাও ফিরে যায় যে যার বাড়িতে। আর থাকত আপিসের কেরানিবাবুরা, কলকাতার আশপাশ থেকে এসে আপিস করে ফিরে যায় রোজ। সেই একঘেয়েমির মধ্যে আমরা দু-চারজন জুড়ে দিলুম গানবাজনা। কি উৎসাহ আমাদের, দু-দিনেই জমে উঠল খুব। রায়বাহাদুর বৈকুণ্ঠ বোস মশায় বৃদ্ধ ভদ্রলোক, তিনিও আসেন স্টীমারে বেড়াতে। সম্প্রতি অসুখ থেকে উঠেছেন, খুব ভাল বাঁয়া তবলা বাজাতে পারতেন এককালে, তিনিও জুটে পড়লেন আমাদের দলে বাঁয়া তবলা নিয়ে। কানে একদম শুনতে পেতেন না, কিন্তু কি চমৎকার তবলা বাজাতেন। বললুম, ‘কি করে পারেন?’ তিনি বললেন, ‘গাইয়ের মুখ দেখেই বুঝে নিই।’ গানও হত, নিধুবাবুর টপ্পা, গোপাল উড়ের যাত্রা, এই সব। গানবাজনায় হৈ হৈ করতে করতে চলেছি—এদিকে গঙ্গাও দেখছি। এ খেয়ায় ও খেয়ায় স্টীমার থেমে লোক তুলে নিচ্ছে, ফেরি বোটও চলেছে যাত্রী নিয়ে। মাঝে মাঝে গঙ্গার চর—সে চরও আজকাল আর দেখিনে। ঘুষুড়ির চড়া বরাবর দেখেছি, বাবামশায়দের আমলেও তাঁরা যখন পলতার বাগানে যেতেন, ওই চরে থেমে স্নান করে রান্নাবান্নাও হত কখনো কখনো চরে,