পাতা:জোড়াসাঁকোর ধারে.djvu/১২৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জোড়াসাঁকোর ধারে
১১৭

বৈকুণ্ঠবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘ঘোড়া উঠেছে, ঘোড়া উঠেছে, ওই দেখুন, সামনে।’ চেয়ে দেখি বরানগরের পরামানিক ঘাটের কাছ বরাবর একজোড়া কালো ঘোড়। জল থেকে উঠছে। স্নান করাতে জলে নামিয়েছিল তাদের। অমনি রব উঠে গেল, আমাদের ঘোড়া উঠেছে, ঘোড়া উঠেছে। গঙ্গাযাত্রীদের কপালে ঘোড়া ওই জল থেকেই উঠে রইল শেষ পর্যন্ত।

 কি দুরন্তপনা করেছি তখন মা গঙ্গার বুকে। কত রকমের লোক দেখেছি, কতরকম ক্যারেক্টার সব। একদিন এক সাহেব এসে ঢুকল স্টীমারে। গঙ্গাপারের কোন্‌ মিলের সাহেব, লম্বাচওড়া জোয়ান ছোকরা, হাতে টেনিস ব্যাট, দেখেই মনে হয় সদ্য এসেছে বিলেত থেকে। সাহেব দেখেই তো আমরা যে যার পা ছড়িয়ে গম্ভীর ভাবে বসলুম সবাই, মুখে চুরুট ধরিয়ে। সাহেব ঢুকে এদিক ওদিক তাকাতেই সেই ডিস্‌পেপটিক উকিল তাড়াতাড়ি তাঁর জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। সাহেব বসে পড়ল সেখানে। আড়ে আড়ে দেখলুম, এমন রাগ হল সেই উকিলের উপর। সঙ্গে সঙ্গে সাহেবের চাপরাসিও এসে জায়গার জন্য ঠেলাঠেলি করতে লাগল ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট হাতে নিয়ে—টিকিট আছে তো এখানে সে বসবে না কেন? অবিনাশ তো উঠল রুখে, বললে, ‘ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট আছে তো নিচে যা, সেখানে কেবিনে বোস গিয়ে—এখানে আমাদের সমান হয়ে বসবি কি?’ বলে জামার হাতা গুটোতে লাগল। দেখি একটা গোলযোগ বাধবার জোগাড়। গোলযোগ শুনে সাহেবও উঠে দাঁড়িয়েছে, বুঝতে পারছে না কিছু। সাহেবকে বললুম, ‘চাপরাসিকে এখানে ঢুকিয়েছ কেন, তাকে পিছনে যেতে বল।’ বিলিতি সাহেব, এদেশের হালচাল জানে না, ব্যাপারটা বুঝে চাপরাসিকে পিছনে পাঠিয়ে দিলে। সাহেবটি লোক ছিল ভালো। খানিক বাদে সে নেমে গেল চাপরাসিকে নিয়ে। উকিলকে বললুম, ‘সাহেব তোমায় কি জিজ্ঞেস করছিল হে?’ সে বললে, ‘সাহেব জানতে চাইলে তুমি কে।’ বললুম, ‘নাম দিয়ে দিলে বুঝি?’ সে বললে, ‘হ্যাঁ।’ বললুম, ‘বেশ করেছ, এত লোক থাকতে তুমি আমারই নাম দিতে গেলে কেন? এবার আমার নামে কেস করলেই মারা পড়েছি।’ চিরকালের ভীতু আমি, ভয় পেয়েছিলুম বই কি একটু।

 ‘পথে বিপথে’র জাহাজী গল্পগুলি আমি তখনই লিখি। স্টীমারের সেই সব ক্যারেকটারই গেঁথে গেঁথে দিয়েছি তাতে। অনেক দিন বাদে ভাদরের ভরা গঙ্গার ছবি এঁকেছিলুম দু-চারখানি। একজিবিশনে দিয়েছিলুম, কোথায় গেল তা কে জানে। একখানি মনে আছে, রুমানিয়ার রাজা নিলেন, গঙ্গার ছবি রুমানিয়ার