পাতা:জোড়াসাঁকোর ধারে.djvu/১৪৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৪২
জোড়াসাঁকোর ধারে

এখনো সেই বুড়ি আছে কিনা, মূর্তি আছে কিনা কে জানে। পাণ্ডারা আমল দেয় না। বোধ হয় ভাঙা বলে ফেলে দিয়েছিল, বুড়ি তাকে পূজো করত। প্রাণ ঠাণ্ডা হয়ে গেল, কিন্তু ঘরে আনতে পারলেম না এই দুঃখ রইল।

 তোমরা ‘ভারতশিল্প’‘ভারতশিল্প’ কর, দরদ কি আছে কারো? না পুরীর রাজার, না ম্যানেজারের, না পাণ্ডাদের, দরদ কারো নেই। প্রমাণ দিই।

 জগন্নাথের মাসির বাড়ি মেরামত হবে। পাণ্ড খবর দিলে, ‘বাবু, দুটো হরিণ যদি কিনতে চাও মাসির বাড়ির, বিক্রি হবে।’

 বললুম, ‘সে কি রে? পোষা হরিণ সেখানে বড় হয়েছে। আমার দরকার নেই সে হরিণের। ভাঙা মূর্তি থাকে তো বল্‌।

 পাণ্ডা বললে, ‘সে কত চাই বাবু, বলুন। অনেক মিলবে।’

 বললুম, ‘আজই চল্‌ তবে সেখানে দেখি গিয়ে।’

 গেলুম, তখন সন্ধ্যেবেলা। সে গিয়ে যা দেখি। মাসির বাড়ি যেন ভূমিকম্পে উলটে পালটে গেছে। চুড়োর সিংহ পড়েছে ভুঁয়ে, পাতালের মধ্যে যে ভিত শিকড় গেড়ে দাঁড়িয়ে ছিল এতকাল সে শুয়ে পড়েছে মাটির উপরে, সব তছনছ। বড় বড় সিংহ নিয়ে কি করব? ছোটখাটো মূর্তি পেলে নিয়ে আসা সহজ। ভিতরে গেলুম। সেখানেও তাই। এখানকার জিনিস ওখানে। কেমন একটা ত্রাস উপস্থিত হল। পাণ্ডাকে শুধালেম, এই পাথরের কাজ ঝেড়ে ঝুড়ে পরিষ্কার করে যেমন ছিল তেমনি করে তুলে দেওয়া হবে তো মেরামতের সময়?

 তার কথার ভাবে বুঝলেম এই সব জগদ্দল পাথর ওঠায় যেখানকার সেখানে, এমন লোক নেই। বুঝলেম এ সংস্কার নয়, সৎকার। ভাঙা মন্দিরে মানুষের গলার আওয়াজ পেয়ে একজোড়া প্রকাণ্ড নীল হরিণ চার চোখে প্রকাণ্ড একটা বিস্ময় নিয়ে আমার কাছে এগিয়ে এল। কতকালের পোষা হরিণ, এই মন্দিরের বাগানে জন্ম নিয়ে এতটুকু থেকে এত বড়টি হয়েছে—আজ এদের বিক্রি করা হবে। আর, এদের সঙ্গে সঙ্গে যে বাগান বড় হতে হতে প্রায় বন হয়ে উঠেছে, বনস্পতি যেখানে গভীর ছায়া দিচ্ছে, পাথি যেখানে গাইছে, হরিণ যেখানে খেলছে, সেই বনফুলের পরিমলে ভরা পুরোনো বাগানটা চষে ফেলে যাত্রীদের জন্য রন্ধনশালা বসানো হবে।

 আমার যন্ত্রণাভোগের তখনও শেষ হয়নি। তাই ঘুরতে ঘুরতে একটা ডবল তালা দেওয়া ঘর দেখিয়ে বললেম, ‘এটাতে কি? পাণ্ডা আস্তে আস্তে