৩
এখন স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে নামকাটা সেপায়ের কি বিপদ হল শোনো। স্কুলে যাওয়ার থেকে তো নিস্তার পেলুম, ভাবলুম বেশ হল, এবার বড়দের মতোই বুঝি আমি স্বাধীন হয়ে গেলুম। যা ইচ্ছে তাই করতে পারব, স্নানের জন্য, ভাত খাবার জন্য চাকররা আর তাড়া দেবে না। নিয়মমতো চলবারও দরকার হবে না। লম্বা পুজোর ছুটি, গরমের ছুটি পেলে যেমন আনন্দ হয় তেমনি আনন্দে দিন কাটবে বুঝি। কবে স্কুল খুলবে সে ভয়ও নেই। এই সব ফুর্তিতেই মাতলুম।
কিন্তু দুদিন যেতে না যেতেই দেখি, ওমা, তা তো নয়। যদু ঘোষাল মাস্টার বাড়িতেই থাকেন; ঠিক সময়ে পড়তে বসতে হয় তাঁর কাছে। দশটা বাজলেই চাকররা তাড়া লাগায়। স্নান করে খেয়ে নিতে হয় চটপট। খেয়েদেয়ে ঘুর্ ঘুর্ করি। স্কুল ছুটি তো শুধু আমারই হয়েছে। দাদা, ইন্দুদা ওঁরা সবাই চলে যান ইস্কুলে। ভেবেছিলেম, বেশ খেলাধুলো হুটোপাটি করে সময় কাটবে রোজ। তা আর হয় না। খেলব কার সঙ্গে? খেলার সাথীরা সবাই স্কুল করে, আমি একলা ঘরে কি করি ভেবে পাইনে। চাকররা থাকে তাদের কাজে ব্যস্ত। রামলাল ধমক দেয়, ‘কোথাও যেয়ো না, চুপটি করে বসে থাকো। এদিকে ওদিকে গেছ কি মুশকিল হবে বলে দিচ্ছি। গলির মোড়ে ওই ওইখানে কন্ধকাটা আছে,ধরে নেবে।’ বলে গলির মোড়ে একটা বাসাবাড়ির নিচে ড্রেনের খিলেন ছিল, সেইটে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। আগে অন্দরে যেতে পারতুম যখন-তখন। আজকাল সেই যে চাকররা সকালবেলা আমায় বের করে আনে অন্দর থেকে, সারাদিনে আর ভিভরে ঢুকবার হুকুম নেই, তবু দু-এক ফাঁকে ঢুকে পড়ি অন্দরে। মা ব্যস্ত ছোটভাইকে নিয়ে। সুনয়নী বিনয়নী ছোটবোন—তাদের সঙ্গে খেলতে খেলতে খেলনা একটা ভেঙে গেল কি তারা কাঁদতে শুরু করে দিলে, ‘অ্যাঁ, অবনদাদা আমাদের পুতুল ভেঙে দিলে।’ অমনি তাড়া লাগায় আমায় সকলে, ‘তুই এখানে কেন? যা বাইরে যা। সেখানে গিয়ে খেলা কর্।’ তাড়া খেয়ে বাইরে চলে আসি। বাইরে এসে ভাবের লোক আর পাইনে কাউকে। সবাই দেখি তাড়া লাগায়, ধমক দেয়।
বাবামশায়ের ছিল পোষা একটি কাকাতুয়া গোলাপী রঙের। বারান্দার দেয়ালে-টাঙানো হরিণের শিঙের উপর বসে থাকে, কি সুন্দর লাগে দেখতে।