পাতা:জোড়াসাঁকোর ধারে.djvu/১৫৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জোড়াসাঁকোর ধারে
১৪৯

আমার জীবনের সব কিছু অভিজ্ঞতা এতেই পাবে।’ ব্যস্‌, তার পর থেকেই ছবি আঁকা বন্ধ। কি জানি, কেন মন বসত না ছবি আঁকতে। নতুন নতুন যাত্রার পালা লিখতুম; ছেলেদের নিয়ে যাত্রা করতুম, তাদের সাজাতুম, নিজে অধিকারী সাজতুম, ফুটো ঢোল বাজাতুম, স্টেজ সাজাতুম। বেশ দিন যায়।

 রবিকা বললেন, “অবন, তোমার হল কি? ছবি আঁকা ছাড়লে কেন?

 বললুম, “কি জানো রবিকা, এখন যা ইচ্ছে করি তাই এঁকে ফেলতে পারি। সেজন্যই চিত্রকর্মে আর মন বসে না। নতুন খেলার জন্যে মন ব্যস্ত।’

 এবার আবার এতকাল বাদে ছবি আঁকতে বসলুম। এ যেন নতুন সঙ্গী জুটিয়ে আর একবার পিছিয়ে গিয়ে পুরোনো রাস্তা মাড়ানোর মজা পাওয়া।

 সবারই একটি করে জন্মতারা থাকে, আমারও আছে। সেই আমার জন্মতারার রশ্মি পৃথিবীর বুকে অন্ধকারে ছায়াপথ বেয়ে নেমে এসে পড়েছে অগাধ জলে। সেই দিন থেকে তার চলা শুরু হয়েছে।

 তার পর একদিন চলতে চলতে, ঝিক ঝিক করতে করতে যখন এসে ঘাটে পৌঁছল, পৃথিবীর মাটিতে ম্লান আলো ঠেকল, সেখানে কি হল? না, সেখানে সেই আলো একটি নাম-রূপ পেলে, সেই আমি।

 জন্মতারার আলো জীবননদী বেয়ে এসে তীরে ঠেকল। ওই ঘাটের ধারে দাড়িয়ে অবনীন্দ্রনাথ দেখলে—‘কোত্থেকে এলুম, এবারে কোথায় চলতে হবে।’

 ঘাটে এসে ঠেকলুম, এবার চলা শুরু করতে হবে। মালবাহী গাধার মত, উদরের বোঝা পৃষ্ঠের বোঝা সব বোঝা নিয়ে জীবনের মুটে তখন চলেছে পথে, অতি ভীত ভাবে—কিছু দেখলেই ভয়ে পিছু হটে, তাকেও যে দেখে ভয়ে ছুটে পালায়। ঘাট ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল নানা জিনিস সংগ্রহ করতে হাটে, খানিকটা খেলার মত। অনেকদিন ধরে খেলার আয়োজন চলল। যেন সে একটি হারুয়া ছেলের মন, সে বাসায় ঢুকতে চাচ্ছে, গাছে চড়তে চাচ্ছে, ঠিক করতে পারছে না, চাঁদের মত উঁকিঝুঁকি মারছে গাছের আড়াল থেকে। ঘরের বুড়ি দাসী কোলে করে গায়—

ওই এক চাঁদ, এই এক চাঁদ
চাঁদে চাঁদে মেশামেশি।

 এবারে খোঁজাখুজির পালা। কি নিয়ে খেলব? সঙ্গে আছে কে? ঘরের মানুষ বুড়ি দাসী। তার থেকেও জীবন রস টানছে। বাইরে থেকেও টানছে, ঘর থেকেও টানছে। যেমন ঘরের দাসী তেমনি পোষা পশুপাখি এরাও।